
সংগৃহীত
এখন আমরা নিজেদের জীবনের রঙিন অংশগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখাতে ব্যস্ত। টাটকা সেলফি, বাসি স্মৃতিকথা, দুর্দান্ত ভ্রমণের ভিডিও, রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে মজার রিল, বিরাট সাফল্য নিয়ে দীর্ঘ স্ট্যাটাস—কিছুই বাদ পড়ছে না। এমনকি একান্ত পারিবারিক বিষয়ও উঠে আসছে অবলীলায়।
তবে একটা ছোট গোষ্ঠী এসব থেকে পুরোপুরি দূরে। কারও কোনো স্ট্যাটাস আপডেট নেই, সেলফি পোস্ট নেই, রহস্যময় কোনো স্টোরিও নেই। কেবলই নীরবতা। সম্পর্কবিষয়ক গবেষকদের মতে, সবকিছু জানাতে না চাওয়াতেও থাকে একধরনের নীরব আত্মবিশ্বাস। আর যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দূরে থাকেন, তাঁরা অসামাজিক নন, তাঁরা কেবল অন্যরকম মূল্যবোধে জীবনকে দেখেন। গবেষকেরা এ ধরনের মানুষের মধ্যে কিছু কমন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। যেসব বৈশিষ্ট্য তাঁদের আলাদা করে তোলে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক এমন ৭টি বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত থাকে সেসব ব্যক্তির মধ্যে, যাঁরা ‘দেখানো’ নয়, বরং ‘নিজেকে জানা’য় বেশি গুরুত্ব দেন।
১. নিজের ভেতরের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত
তাঁরা অনেকটাই আত্মমুখী। নিজেদের চিন্তা, অনুভূতি আর লক্ষ্য নিয়ে সময় কাটান। বাইরের প্রতিক্রিয়া বা লাইক–কমেন্ট তাঁদের কাছে খুব জরুরি নয়। তাঁদের কাছে নিজের মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাসই আসল বিষয়।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: প্রতিদিন কিছু সময় রাখুন নিজের জন্য। চুপচাপ বসে ভাবুন, আপনি কেমন আছেন, কী করতে চান, আর কী আপনাকে শান্তি দেয়।
২. সময়কে মূল্য দেন
অকারণ স্ক্রল, ট্রেন্ড ফলো করা বা অন্যের জীবনের আপডেট দেখা—এসব থেকে তাঁরা দূরে থাকেন। তাঁরা বুঝে ফেলেছেন, সময় অমূল্য। এই সময় তাঁরা ব্যবহার করেন পড়াশোনায়, প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলায় বা নিজের সঙ্গ উপভোগে।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: এক দিন চেষ্টা করুন এক ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম না দেখে থাকতে। দেখুন, সময়টা কত বেশি অর্থবহ মনে হয়।
৩. সম্পর্কের গভীরতা খোঁজেন
তাঁরা বন্ধু চান, ফলোয়ার নয়। সংখ্যার চেয়ে মান তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এমন সম্পর্ক চান, যা সত্যিকারের; যেখানে বোঝাপড়া আর বিশ্বাস থাকে, শুধু অনলাইনে সুন্দর দেখানোর জন্য নয়।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: আজই এমন কারও সঙ্গে কথা বলুন, যাঁর সঙ্গে আপনি সত্যিই খোলামেলা হতে পারেন।
৪. শান্ত ও স্থির মেজাজের মানুষ
অনলাইন বিতর্ক, আবেগতাড়িত পোস্ট বা ঝগড়ায় তাঁরা জড়ান না। নিজেদের আবেগ তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন। তাঁরা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে ভাবেন, এটা কি সত্যিই প্রয়োজন?
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: কোনো কিছু লিখে পোস্ট করার আগে ১০ সেকেন্ড বিরতি নিন। ভাবুন, এটা বললে আসলে কী লাভ হবে?
৫. আত্মনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী
তাঁরা কারও প্রশংসা বা অনুমোদনের অপেক্ষা করেন না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেন। বাইরের স্বীকৃতির চেয়ে নিজের সন্তুষ্টিই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: আজ এমন একটি কাজ করুন, যা আপনি নিজের জন্য করতে চান—কাউকে মুগ্ধ করার জন্য নয়।
৬. ব্যক্তিগত সীমারেখা মানেন
কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন—সব কিছু সবাইকে জানানো তাঁদের পছন্দ নয়। তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তাকে গুরুত্ব দেন। তাঁদের কাছে নিজের বিষয় নিজের কাছেই রাখা এক ধরনের মানসিক শান্তি।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: নিজের জীবনের অন্তত একটি বিষয় ঠিক করুন, যা অনলাইনে কখনো শেয়ার করবেন না।
৭. বর্তমানে থাকতে জানেন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার আগে তাঁরা মুহূর্তটা অনুভব করেন। সূর্যাস্ত দেখার সময় ছবি তোলার চেয়ে সূর্যাস্তটা উপভোগ করাই তাঁদের কাছে বেশি মূল্যবান।
যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য পরামর্শ: আজ সন্ধ্যায় ফোনটা হাতের নাগালের বাইরে রেখে হাঁটতে বের হোন। চারপাশটা এমনভাবে দেখুন, শুনুন ও অনুভব করুন, যেন আপনি কেবল বর্তমান সময়টা গভীরভাবে উপভোগ করতে পারেন।
শেষ কথা
গবেষকেরা বলেন, আমরা যদি ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটু গোপনীয়তা এবং আরেকটু একটু কম প্রদর্শনের অভ্যাস করতাম, তাহলে হয়তো জীবনটা আরও সহজ হতো। অনলাইনে কিছু শেয়ার করা খারাপ নয়। এটি অনেকের জন্য যোগাযোগ ও আনন্দের জায়গা।
কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, প্রতিবার কিছু পোস্ট করার পেছনে সময়, মানসিক শক্তি আর অনেক সময় আত্মমর্যাদারও একটা অংশ খরচ হয়।
যাঁরা এসব থেকে দূরে থাকেন, তাঁরা যে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না, তা নয়। বরং তাঁরা হয়তো নিজের সঙ্গে, নিজের কাছের মানুষদের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত। তাঁরা হয়তো সচেতনভাবেই এসব থেকে একটু দূরে থাকেন; কারণ, তাঁরা শান্তি খোঁজেন নিজের ভেতর, অন্যের ফিডে নয়।
নীরব শক্তি, আত্মনির্ভরতা আর আন্তরিক সম্পর্কের মূল্য বুঝে চলা মানুষদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। আপনি নিয়মিত পোস্ট দেন বা খুব কম—দুই ক্ষেত্রেই একবার থেমে ভেবে দেখা যেতে পারে, আমরা কেন শেয়ার করি? আর এতে আমরা আদতে কী পাই, বা কী হারাই?
সূত্র: প্রথম আলো