বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ৬ কার্তিক ১৪৩২

কার্ড বদল করে ‘ফ্রি যাত্রা’, মেট্রোরেলে নতুন জালিয়াতি

কার্ড বদল করে ‘ফ্রি যাত্রা’, মেট্রোরেলে নতুন জালিয়াতি

সংগৃহীত

ঢাকা মেট্রোরেলে অভিনব কৌশলে চলছিল ভাড়া জালিয়াতি। একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়ার পর টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। তবে এই জালিয়াতি বন্ধ করতে গিয়ে ‘একই স্টেশনে বিনা ভাড়ায় প্রবেশ ও বাহির’ হওয়ার সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। তাদের প্রশ্ন, একটি চক্রের অন্যায়ের শাস্তি কেন পাবেন সবাই?

মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, এমআরটি পাস বা র‍্যাপিড পাস কার্ড ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিনা ভাড়ায় এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাতায়াত করছিল। বিষয়টি ধরা পড়ার পরই সোমবার (২০ অক্টোবর) থেকে ‘বিনা ভাড়ায় এন্ট্রি-এক্সিট’ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

একটি সংঘবদ্ধ চক্রের 'ঢুকতেন একজন, বের হতেন আরেকজন' কৌশলে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এই প্রতারণা রুখতে বন্ধ হলো যাত্রীবান্ধব একই স্টেশনে ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট সুবিধা / ঢাকা পোস্ট

তবে এই সুবিধা বন্ধ করায় বিপাকে পরেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলছেন, মাথাব্যথা হলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু মাথা কেটে সমস্যার সমাধান হয় না।

ঢুকতেন একজন, বের হতেন আরেকজন : ধরা পড়ে ১০টিরও বেশি ঘটনা

ডিএমটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রতারণার কৌশলটি ছিল বেশ অভিনব। চক্রের সদস্যরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যেত— এক দল থাকতো ট্রেন ছাড়ার স্টেশনে, অন্য দল গন্তব্যে।

শুরুর স্টেশনে দলের একজন কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেন। এরপর তিনি কার্ডটি স্টেশনের ভেতরেই থাকা তার সঙ্গীকে দিয়ে দিতেন, যে সঙ্গে সঙ্গে কার্ডটি পাঞ্চ করে বেরিয়ে যেতেন। ফলে মেট্রোরেলের সিস্টেমে দেখাতো, যাত্রী যে স্টেশন থেকে ঢুকেছেন, সেখানেই বেরিয়ে গেছেন। এতে কোনো ভাড়া কাটা হতো না। অথচ কার্ড ছাড়া প্রথম যাত্রী ঠিকই ট্রেনে চড়ে নিজের গন্তব্যে চলে যেতেন। সেখানে থাকা চক্রের অন্য সদস্যরা তাকে স্টেশন থেকে বের হতে সাহায্য করত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চক্রটি প্রতিদিন অসংখ্যবার এভাবে বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করে আসছিল।

চক্রের একজন কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকত এবং কার্ডটি ভেতরে থাকা অন্য সঙ্গীকে ফেরত দিত, যিনি কার্ড পাঞ্চ করে তখনই বেরিয়ে যেতেন। ফলে সিস্টেমে একই স্টেশনে ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট দেখানো হতো। এভাবে যাত্রী বিনা ভাড়ায় গন্তব্যে যেত। এমন ১০টির বেশি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে ডিএমটিসিএল

একাধিক স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ ও ইলেকট্রনিক টিকিটিং রেকর্ড বিশ্লেষণ করে এমন ১০টির বেশি চক্রের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে ডিএমটিসিএল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ, প্রতিদিন গড়ে আড়াই লাখেরও বেশি যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করেন। ফলে এসব অনিয়ম শনাক্ত করা বেশ জটিল হয়ে পড়ে।

১০টির বেশি প্রতারক চক্রের প্রমাণ মেলায় কঠোর হয়েছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ /

ডিএমটিসিএলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি— কিছু যাত্রী একাধিকবার একই স্টেশনে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পরে তাদের কার্ডের ডেটা ঘেঁটে দেখা যায়, একই কার্ডে একই স্টেশনে পুনরায় যাতায়াতের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে। এতে বোঝা যায় কার্ডটি বিনা পয়সায় ভ্রমণের জন্য কেউ ব্যবহার করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বহু অসাধু যাত্রী এন্ট্রি গেইটে কার্ড টাচ করে পাশে থাকা এক্সিট গেইটেও টাচ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা স্টেশনের পেইড জোন ত্যাগ করেন না। তারা ট্রেনে উঠে গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে কর্তব্যরত সিকিউরিটি গার্ডকে বলেন— ভাই, কার্ড মনে হয় পাঞ্চ হয়নি, একটু পাঞ্চ দিয়ে দেন। এরপর তারা অন্য দিক দিয়ে এক্সিট করেন। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে দীর্ঘদিন তারা সুকৌশলে ভাড়া বা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছিলেন।’

বন্ধ হলো ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট সুবিধা

সম্প্রতি ডিএমটিসিলের এক নোটিশে বলা হয়েছে, ‘যাত্রীসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমানে একই স্টেশনে বিনা ভাড়ায় এন্ট্রি-এক্সিট বন্ধ আছে। একই স্টেশনে এন্ট্রি করে এক্সিট করলে ১০০ টাকা ভাড়া কর্তন হবে।’

এর আগে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিয়ম ছিল, কেউ যদি ভুলবশত বা প্রয়োজনে কার্ড স্ক্যান করে স্টেশনে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যান, তাহলে তাকে কোনো ভাড়া দিতে হতো না। এই ‘ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট’ সুবিধা যাত্রীবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে চালু ছিল। কিন্তু চক্রটি সেই নিয়মের অপব্যবহার করায় ডিএমটিসিএল নতুন সিদ্ধান্ত নেয়।

কিছু যাত্রী একাধিকবার একই স্টেশনে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পরে তাদের কার্ডের ডেটা ঘেঁটে দেখা যায়, একই কার্ডে একই স্টেশনে পুনরায় যাতায়াতের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে। এতে বোঝা যায় কার্ডটি বিনা পয়সায় ভ্রমণের জন্য কেউ ব্যবহার করছে ডিএমটিসিএল কর্মকর্তা

নতুন নিয়ম গতকাল ২০ অক্টোবর বিকেল থেকে কার্যকর হয়েছে। এখন থেকে কেউ ভুলবশত কার্ড স্ক্যান করলেও ভাড়া কাটা যাবে, যা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এখন থেকে একই স্টেশনে ঢুকে বেরোলে ১০০ টাকা কাটা যাবে। কর্তৃপক্ষের দাবি, লাখ লাখ টাকা ক্ষতি এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে / ঢাকা পোস্ট

এদিকে নতুন নিয়ম নিয়ে অবগত ছিলেন না মেট্রোরেলের বিভিন্ন সেবায় নিয়োজিত থাকা একাধিক কর্মী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গতকাল ডিউটির সময় হঠাৎ করেই লক্ষ্য করা যায় যে স্ক্যান করে স্টেশনে প্রবেশ করা কোনো কার্ডেই এক্সিট প্রক্রিয়াটি কাজ করছে না। অফিসিয়ালি কোনো পূর্ব ঘোষণা না থাকায় বিষয়টি আমাদের কাছেও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। এই আকস্মিক সমস্যার কারণ সম্পর্কে আমরা নিজেরা অবগত ছিলাম না, এবং তাৎক্ষণিকভাবে কন্ট্রোল রুম বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও কোনো তথ্য দিতে পারেননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিয়মের এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনটির ফলে অপারেশনাল কার্যক্রমে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয় এবং যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। সমস্যাটি গতকাল থেকে শুরু হয়েছে, এবং আজও দু-একটি একই ধরনের ঘটনা নজরে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, আমাদেরকে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।’

মেট্রোরেলের নতুন সিদ্ধান্তে যাত্রীদের ক্ষোভ

নতুন নিয়মের জেরে অনেক যাত্রীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কার্ড স্ক্যান করতে ভুল হলে কিংবা আকস্মিক প্রয়োজনে একই স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেলে কেন সাধারণ যাত্রীদের ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে?

মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী আসাদ আবেদিন জয় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্টেশনে ঢুকে বের হলে এখন থেকে ১০০ টাকা জরিমানা কাটা হবে। এটা আমার জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়। আগে তো ২০ টাকা থাকলেই জরুরি প্রয়োজনে স্টেশনে ঢুকে কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ এখন যদি আমাকে যেতে হয়, তাহলে তো ১০০ টাকা কাটবে। এটা আবার কেমন নিয়ম হলো। আমি এসব ক্ষেত্রে প্রতিবার ১০০ টাকা কাটা সত্যিই অন্যায্য এবং সাধারণ মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।’

সার্বজনীন জরিমানা আরোপ না করে কেবল অপব্যবহারকারী চক্রটিকে লক্ষ্য করে পদক্ষেপ নেওয়া হলে সাধারণ যাত্রীদের জন্য ভালো হবে। মাথা ব্যথা হলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে, ওষুধ দিতে হবে। কিন্তু মাথা কেটে সমস্যার সমাধান হয় না
যাত্রী আসাদ আবেদিন

তিনি আরও বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। আপনার কাছে শুনলাম চক্রের কথা। যদি কোনো চক্র এমন কাজ করে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত উপায় হবে টেকনিক্যাল পর্যায়ে লক্ষ্যভিত্তিক কড়াকড়ি, নজরদারি ও দোষীদের দেখে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সার্বজনীন জরিমানা আরোপ না করে কেবল অপব্যবহারকারী চক্রটিকে লক্ষ্য করে পদক্ষেপ নেওয়া হলে সাধারণ যাত্রীদের জন্য ভালো হবে। মাথা ব্যথা হলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে, ওষুধ দিতে হবে। কিন্তু মাথা কেটে সমস্যার সমাধান হয় না।’

মেট্রোরেলে ফ্রি এন্ট্রি-এক্সিট সুবিধা বন্ধ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিয়মিত যাত্রীরা / ঢাকা পোস্ট

নতুন নিয়মে ক্ষুব্ধ সজীব রয় নামে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘ভাই, পাঁচ মিনিটে কি ব্লক করা ঠিক? ব্লক বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একজন বয়স্ক যাত্রী ভুল করে অন্য প্ল্যাটফর্মে নামলে তখন কী করবে? পাস ব্যবহার করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অন্যদিকে নামলে সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন আর তা পারবে না। কাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত, কাদের অসুবিধা হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখতে হবে; যাত্রীদের ওপর একেবারে জরিমানা চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’

আমরা তো মানুষদের ফ্যাসিলিটি দিতে চাই। কিন্তু মানুষ যখন সেটার অপব্যবহার করে তখন কিছু করার থাকে না। মানুষ দুই নম্বরি কাজ করে আমাদের সঙ্গে চিটিং করছে। লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমটিসিএলের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা

মানসীব ইয়ামান নামের একজন লিখেছেন, ‘এখন চুরি-ছিনতাই করে মেট্রো পাস দিয়ে নিজের এলাকায় নেমে পালিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। আর কার্ড করতে তো এনআইডিও লাগে না। তাই এই পদ্ধতি যৌক্তিক। কিছুটা অসুবিধা হলেও যাত্রীদের সুবিধা দিবে।’

এ বিষয়ে জানতে ২১ অক্টোবর দুপুরে একাধিকবার ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদকে ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমটিসিএলের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা তো মানুষদের ফ্যাসিলিটি দিতে চাই। কিন্তু মানুষ যখন সেটার অপব্যবহার করে তখন কিছু করার থাকে না। মানুষ দুই নম্বরি কাজ করে আমাদের সঙ্গে চিটিং করছে। লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।’

সূত্র: ঢাকা পোষ্ট

সর্বশেষ:

শিরোনাম: