রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্টের পর দেশকে উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া হলো : জাফর ইকবাল

১৫ আগস্টের পর দেশকে উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়া হলো : জাফর ইকবাল

দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদনটি শুনানির জন্য ১৬ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

গত ৯ নভেম্বর এ দিন ঠিক করে দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। তবে রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে বিচারপতির সংখ্যা নিয়ে আপত্তি জানাবেন রিটকারী আইনজীবী।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রেখেছিলেন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি। কিন্তু বর্তমানে আপিল বিভাগে আছেন ছয়জন বিচারপতি। এ ক্ষেত্রে রিভিউ শুনানির জন্য আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির দাবি তুলবেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নেয়া সংক্রান্ত বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদনটি দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে পুরো রায়টি বাতিল চাওয়া হয়।

রিভিউ শুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, সরকার পক্ষ চাচ্ছে রিভিউ শুনানি হোক। এখন শুনানি কীভাবে হবে তা বলতে পারছি না। তার কারণ হলো এ মামলায় রায় দিয়েছিলেন সাতজন বিচারপতি। এখন আপিল বিভাগে সাতজন বিচারপতি নেই।

সাত বিচারপতির রায়ের রিভিউ আবেদন ছয় বিচারপতি কিংবা তার কমসংখ্যক বিচারপতি শুনানি করতে আইনে কোনো বাধা আছে কি না জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী বলেন, আইনে বাধা নেই। কিন্তু এটা তো আমাদের কোর্টের কাস্টম (প্রথা)। যে কয়েকজন বিচারপতি রায় দিয়েছেন, সেই সংখ্যক বিচারপতি রিভিউ শোনেন।

তিনি বলেন, এর আগেও রিভিউর মামলায় প্রধান বিচারপতি, তার আগেও প্রধান বিচারপতি তাদেরকে তো দেখেছি যতজনের রায় ততজনের কমসংখ্যক বিচারপতি রিভিউ শোনেননি। এটাই কাস্টম (রীতি)। এই পয়েন্টটি অবশ্যই আমরা আদালতের নজরে আনব।

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, এ রিভিউ শুনানির ক্ষেত্রে বিচারকের সংখ্যা কোনো বাধা নয়। আপিল বিভাগের ফুল (পূর্ণাঙ্গ) বেঞ্চ হলেই হলো। ফুল বেঞ্চ রিভিউ শুনানি করতে পারবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একই মত দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, রিভিউ যে কোনো সংখ্যক বিচারপতি শুনতে পারবেন, সেই এখতিয়ার আদালতের দেয়া আছে। রায় প্রদানকারী বিচারপতিদের চেয়ে কম সংখ্যক বিচারপতি থাকলেও রিভিউ শুনানি করতে পারবেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার আলাদাভাবে রায় লিখলেও সবাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। আর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে পুরোপুরি সহমত পোষণ করেন। এই সাত বিচারপতির কেউই এখন আপিল বিভাগে নেই, তারা সবাই অবসরে গেছেন।

বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতি আছেন ছয়জন। তারা হলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার আলোচিত এ রিভিউ শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তার গেজেট হয়। এরপর ওই ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। পরে ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই রিটে রুল জারি করেন। এরপর ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান-পরিপন্থি বলে রায় ঘোষণা করেন। একই বছরের ১১ আগস্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর ওই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।

যে যুক্তিতে রিভিউ করা হয়

সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ উল্লেখ করে রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের ফাউন্ডিং ফাদার রূপে স্বীকৃত। আপিল বিভাগ ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে ভুল করেছেন। তাই এর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। রায়ের একটি অংশে পর্যবেক্ষণে ‘আমিত্ব’ ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে বলে যা উল্লেখ আছে, সে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনে যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত। যা আমাদের এই মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি সংশোধনযোগ্য।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘১. আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনো শিশুসুলভ; ২. এখনো এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি ‘ এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, এই পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এই পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে, যা সংশোধনযোগ্য। ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী।’ এর সুরাহা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয়, বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্ন। আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এ মন্তব্য করা হয়েছে।

রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরূপ মন্তব্য করতে পারে না। এটা বিচারিক মন্তব্য নয়, এ মন্তব্য করে আদালত ভুল করেছেন, যা সংশোধনযোগ্য ও বাতিলযোগ্য বলেও রিভিউ আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ