জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসরাফিল হোসাইনের পড়ালেখা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন মানবকণ্ঠের উপ-সম্পাদক সৈয়দ আতিক। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সৈয়দ আতিক বলেন, এখন আর তাকে এক বেলার খাবার তিনবেলা ভাগ করে খেতে হবে না। অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না। এখন থেকে সে তিনবেলা খাবে। অন্য আর দশজনের মতোই হেসে খেলে পড়ালেখা করে বড় হবে।
সৈয়দ আতিক বলেন, মানুষের কাজ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বিপদে-আপদে, দুঃখ-কষ্টে কারো পাশে দাঁড়াতে পারলেই মানব জনম সার্থক। এতে রয়েছে স্বর্গ সুখ।
ইসরাফিল হোসাইন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দেয়া মোটেই সহজ ছিল না। হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আসতে হয়েছে। শৈশব থেকে প্রচণ্ড অভাব সব সময় তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই অভাব এখনও তার পিছু ছাড়েনি। এক বেলার খাবার তিনি তিনবেলা ভাগ করে খান।
আলাপকালে ইসরাফিল বলেন, তারা দুই ভাই-বোন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সাভারের ডেন্ডাবর এলাকায় থাকতেন তারা। ছিল না কোনো পৈত্রিক সম্পতি; কিন্তু ছিল একরাশ সুখ। তার বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, জীবন সম্পর্কে তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি তারা দুই ভাই-বোন। হঠাৎ একদিন কালবৈশাখী ঝড় তাদের সুখ-স্বপ্ন উড়িয়ে নিয়ে যায়। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। আলাদা হয়ে যান তারা।
নিজেদের সুখের জন্য তারা ফের আলাদাভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু এই বাচ্চা দুটির দায়িত্ব কেউ নেয়নি। বোনকে নিয়ে ইসরাফিলের ঠাঁই হয় অনাথ আশ্রমে। তারপর থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি তাদের। বাবা-মাও তাদের খোঁজ নেননি আর। আশ্রমেই কাটে শৈশব। সেখান থেকে ছোট বোনের বিয়ের ব্যবস্থাও করে দেন শিক্ষকরা। কিন্তু পড়ালেখার ঝোঁক থেকেই যায় ইসরাফিলের। তার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত হওয়া। অদম্য ইচ্ছের কারণে শত প্রতিকূলতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। চালিয়ে যান লেখাপড়া। অনাথ আশ্রম থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার পালা। তিনি ২০১৪-১৫ শিক্ষা বর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। দেন মেধার পরিচয়। মেধা তালিকায় ৫২ স্থান পান। ভর্তি হন লোকপ্রশাসন বিভাগে। কিন্তু এখানেও ঘটে বিপত্তি। কারণ, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য নেই কোনো আবাসিক হল। ইট-পাথরের এ শহরে নেই কোনো আত্মীয় স্বজনও। নিরুপায় হয়ে মেসে উঠেন। মেস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো হয়ে উঠে কষ্টকর। চাকরি নেন সদরঘাটের একটি মার্কেটে নাইট গার্ড পদে। পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। প্রায় ছয় মাস নাইট গার্ডের চাকরি করার পর বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় আবার পড়াশুনা শুরু করেন ইসরাফিল।
কান্না জড়িত কণ্ঠে ইসরাফিল বলেন, অভাব তার সঙ্গ ছাড়ছে না। টাকার অভাবে তিন বেলা ভাত খেতে পারেন না। মেসে তিন বেলা রান্না হলেও তিনি মিল দেন একবারের। একবেলার সেই খাবার ভাগ করে খান দুপুর ও রাতে। ঈদ-উত্সব অথবা সরকারি ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়। রুমমেট আর বন্ধুরা চলে যান বাড়িতে আনন্দ ভাগাভাগি করতে। তখনও ইসরাফিলকে একাই থাকতে হয় মেসে। কারণ স্থায়ী ভাবে বসবাস করার মতো তার কোন ঘর-বাড়ি নেই। এমনকি কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই বেড়াতে যাওয়ার মতো।
বাল্যকাল থেকে লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রবল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অনলাইন ও পত্রিকায় ক্যাম্পাস রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাগজের পাতায় ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের অভাব-অভিযোগ আর সংগ্রামী জীবনের কথাগুলো তুলে ধরলেও নিজের জীবন সংগ্রামের খবরগুলো রেখেছেন আড়াল করে। নিজের অসহায়েত্বের কথাগুলো সব সময়ই গোপন রাখারই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আর কত গোপন রাখবেন। অবশেষে ইসরাফিলের এই কষ্ঠগাথা সংগ্রামী জীবনের কথাগুলো মানবকণ্ঠের সহ-সম্পাদক ফরহাদ শিকদারের মাধ্যমে কানে আসে মানবকণ্ঠের উপ-সম্পাদক সৈয়দ আতিকের। এরপর তিনি ইসরাফিলকে ডেকে তার কষ্টের কথা শুনেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার লেখাপড়াসহ ভরণপোষনের দায়িত্ব নেন।
আলোকিত সিরাজগঞ্জ