শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হিংস্রতায় বিক্ষত স্বদেশভূমি

হিংস্রতায় বিক্ষত স্বদেশভূমি

 

বিশ্বায়নের যুগে আধুনিক চিন্তা-মনন, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। আফ্রিকার পিগমী, মেরু অঞ্চলের এস্কিমো বা দুর্গম মরু অঞ্চলের বানজারান ধরনের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের কথা বাদ দিয়ে সার্বিকীকরণ করে বলব পৃথিবীর অনেকটাই এখন আধুনিকতার আলোতে আলোকিত।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আকাশে তথ্যপ্রযুক্তির অত্যাধুনিক পথ নির্মাণে সাফল্য দেখাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্যের কথা শুনছি- অনুভবও করছি। এর পরই চমকে উঠছি সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চরম অবক্ষয় দেখে।

হতাশ হচ্ছি এই ভেবে দেশের মানুষের মধ্যে যদি মানবিক উৎকর্ষ না থাকে তাহলে এসব উন্নতির শেষ পরিণতি কী হবে! ভেতরে ঘুণপোকা রেখে চকচকে উন্নয়নের মিনারকে দাঁড় করিয়ে রাখা কি সম্ভব হবে?

যে দেশে সাঈদীর মুখ চাঁদে দেখা যায় বলে হাজার হাজার গ্রামবাসীকে উন্মত্ত করে তোলা যায়, ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে হায়েনার মতো দলবদ্ধ মানুষ নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পিটিয়ে জখম করে হত্যা করতে পারে, তেমনি দেশের উন্নয়নের আলো বেশিক্ষণ জ্বলে থাকার কথা নয়।

আসলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি অনেকটাই অর্থহীন এবং এর স্থায়িত্বও ক্ষণস্থায়ী।

এ দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু ক্রমে লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ছে। এসবকে এখন জাতীয় দুর্যোগ বলাই ভালো। এ দুর্যোগের সবই মানবসৃষ্ট। ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে জ্যামিতিক হারে। দুর্নীতি অক্টোপাসের মতো বিষাক্ত হাত ছড়িয়েছে সর্বত্র। সড়ক দুর্ঘটনা মাত্রা ছাড়াচ্ছে এবং নতুন সংযোজন হিসেবে চলছে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা।

এ গণহামলায় নিহত হচ্ছেন যুবক, তরুণী, প্রতিবন্ধী, মা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা- অনেকেই। লক্ষ করতে হবে অধিকাংশ অঘটনের বাড়বাড়ন্ত এ সরকারের সময়েই। তাই সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে সংকটের উৎস।

আমরা এমন ভয়ংকর দুর্যোগে রাজনীতিকদের মতো পরস্পরকে দোষারোপ করে দায় এড়াতে পারব না। এ ধরনের মানবসৃষ্ট জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় সবারই দায়িত্ব রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাবানদের দায় সবচেয়ে বেশি। ধারাক্রম করলে সবচেয়ে বেশি দায় থাকবে সরকার পক্ষের।

কারণ তাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে। প্রচার-প্রচারণায় জনমত তৈরির সামর্থ্য বেশি। আইন প্রয়োগ করার কর্তৃত্ব রয়েছে তাদেরই হাতে। আবার যারা শুধু ক্ষমতায় থাকেন দায়িত্ব কেবল তাদেরই নয়। যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতির চাকা সবসময় সচল রাখেন তাদেরও। রাজনীতি করেন বলে সামাজিক দায়বদ্ধতা তাদেরও রয়েছে।

কিন্তু এসব দায়িত্ব রাজনীতির বিরোধী পক্ষকে আমরা প্রায়ই পালন করতে দেখি না। এ কথা ঠিক, চলমান হিংস্রতার মহামারী থেকে জাতিকে রক্ষা করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার প্রধান দায়িত্ব সরকারের আর সরকারি রাজনৈতিক দলের।

তবে এমন কঠিন বাস্তবতায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা যদি সরকার ঝামেলায় পড়েছে ভেবে মজা নেন এবং নিজ দায়িত্ব পালন না করে সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকেন, তবে তাতে দেশপ্রেমের প্রকাশ হয় না। মহাদুর্যোগকে রাজনীতির সুবিধা লাভের হাতিয়ার মনে করে সুখের হাসি হাসাটা বীভৎসই মনে হবে।

সাধারণ মানুষও নিঃশর্তে এগিয়ে আসতে পারেন মানবিকতার স্লোগান নিয়ে। কিন্তু তাদের ভেতরের একতাকে ভেঙে দিয়েছে বিভক্তির রাজনীতির বেসাতি করা লোভী মানুষরা। দুঃশাসনের ভীতি ছড়ানো আছে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত অংশ মানুষকে নানাভাবে সন্ত্রস্ত রাখছে।

মানবধর্ম পালন করতে গিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে হচ্ছে সবাইকে। চোখের সামনে হিংস্রতার ঘটনা দেখলেও এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না কেউ। নিজের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তটস্থ থাকছে এই ভেবে যে মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে পাছে তাদের না নানাভাবে বিপদে পড়তে হয়!

ছেলেধরার গুজবে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার আতঙ্ক এখন তো মনে হচ্ছে সমাজের সাধারণ গতিকেই থামিয়ে দিচ্ছে। ক’দিন আগে গণপিটুনির বিষয় নিয়ে একটি টিভি চ্যানেল সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নিচ্ছিল। একজন তরুণ কঠিন বাস্তব কথা বলল।

তার আতঙ্কিত উক্তি ‘এখন তো বাড়ির বাইরে বেরোতেই ভয় করে। কারা কখন ছেলেধরা সুর তুলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ আমার মনে হল এর চেয়ে ভয়ংকর বাস্তবতা আর কিছু হতে পারে না। দেশ কি তাহলে একটি অন্ধকার সময় অতিক্রম করছে?

প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে সমাজ এতটা ভেঙে পড়ল কেমন করে? আসলে হঠাৎ নয়। আমার বিবেচনায় আমাদের দেশের (মান্যবর রাজনীতিকরা কষ্ট পেলেও বলব) সব অঘটনের উৎস নষ্ট রাজনীতি।

পাঠক যদি লক্ষ করেন, স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই, বিশেষ করে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের পর থেকে রাজনীতি অনেক বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বার্থবাদী হয়ে পড়েছে। দেশ কল্যাণের চেয়ে ভোগবাদী মানসিকতায় অনেক রাজনীতিক নিজেদের বেঁধে ফেলেছিলেন। নানা ব্যবসায় লক্ষ্মী বসত করেছিলেন।

ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মন্ত্রী-এমপিদের অধিকার থেকে সম্পদের খনি বের করা হয়েছিল। এখনও নির্বাচন এলে হলফনামায় প্রার্থীদের সম্পদের স্ফীতিই চোখে পড়ে।

মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের অধিকাংশের বিশাল বিশাল সম্পদের পরোক্ষ উৎস তো রাজনীতিই। ব্যাংকের বড় বড় ঋণ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার পেছনে কি রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে না?

সেই পোড়খাওয়া রাজনীতি কি এখন খুঁজে পাওয়া যাবে যে, জনকল্যাণ করতে গিয়ে আদর্শিক রাজনীতিকরা পৈতৃক সম্পত্তিটুকুও খোয়াতেন! বর্তমানে নিজ অঞ্চলের ক্ষমতার বলয় ঠিক রাখতে দলীয় লাঠিয়াল পোষেন রাজনীতিকরাই। রাজনীতিকরা পরস্পর সংঘাতে রক্ত ঝরান তো ক্ষমতার দাপট আর অর্থের উৎস করায়ত্ত করতে।

দু’চারজন হাতেগোনা সৎ রাজনীতিক সমাজকে পাল্টাতে পারবেন না। এমন সততার জন্য দলীয় কমিটমেন্ট প্রয়োজন। তা কি আছে আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিতে?

রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও আশকারা না পেলে কি ক্ষমতার সঙ্গে থাকা ছাত্র রাজনীতির তরুণরা চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী হতে পারত? রাজনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি প্রশাসনিক দুর্নীতির পেছনে কি রাজনৈতিক প্রশ্রয় থাকে না?

রাজনৈতিক প্রভাব কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেককে নৈতিকভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে না? বিচার ব্যবস্থা সর্বত্র কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?

এভাবে সমাজকে নৈতিকভাবে জরাগ্রস্ত ও দুর্বল করে দেয়ার দায় কি রাজনীতিকদের নেই? এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ মনে করে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ পুলিশ বা র‌্যাব সবসময় করতে পারে না।

এমন বাস্তবতায় হতাশ ও অতিষ্ঠ মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এরপরও প্রশ্ন, জলজ্যান্ত মানুষকে হায়েনার মতো দলবদ্ধ হয়ে নির্বিচারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কীভাবে? আমাদের ধারণা দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি এমন অমানবিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে অনেককে।

চোখের সামনে দুর্নীতিবাজদের সদম্ভ পদচারণা, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য যে অসহায়ত্বের পরিবেশ তৈরি করেছে, এমন বাস্তবতাই মানুষকে করে তুলছে হিংস্র।

একইসঙ্গে বলা যায়, সরকারের দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা এ গণপিটুনির ক্ষেত্রে কম ভূমিকা রাখেনি। দুর্নীতিগ্রস্ততা- সৎ ও দায়িত্ববান হওয়ার পথকে দুর্বল করে দেয়। না হলে যখন ফেসবুকে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা চাই বলে গুজব রটানো হল তখন এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে না ভেবে দায়িত্বশীলরা শীতঘুম দিলেন কেন!

এ দেশে ছেলেধরার মিথ আমরা ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি। আমাদের মা-দাদিরা ছেলেধরার ভয় দেখিয়ে শাসনে রাখতেন। মানুষ বলি ছাড়া সেতু হয় না এমন লোকজ গল্প অনেক শুনেছি।

যে সমাজের মানুষ এ যন্ত্রযুগেও ‘চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখা যায়’ গুজব বিশ্বাস করে, সে সমাজের মানুষ পদ্মা সেতু কাটা মুণ্ডু চায় তেমন গাঁজাখোরি গুজব যে উড়িয়ে দেবে না তা বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

তাই বলব ফেসবুকের অমন গুজবকে দূরদর্শিতা দিয়ে আমলে আনা উচিত ছিল দায়িত্বশীলদের। এ গুজব পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে দেশবাসীকে সচেতন করার কার্যক্রম নেয়াই ছিল জরুরি। এটি যে নিছকই একটি গুজব, সরকার চাইলেই স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সচেতনতার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারত। বলতেই হবে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টজনরা।

টেলিভিশনে অনেক মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। তারা অনেকে বলছিলেন গুজব আমলে না এনে উপায় কী! দেশজুড়ে নানা অঘটন ক্রমাগত ঘটে যাচ্ছে। তাই নিজ সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে সব অভিভাবকই উৎকণ্ঠিত।

এমন পরিবেশে এ ধারার গুজব শুনে বাছ-বিচারের সুযোগ কোথায় তাদের! অব্যাহত ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো কিছুই তো নিবারণ করা যাচ্ছে না।

এমন নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশে নিজ সন্তানকে রক্ষা করার জন্য তারা যদি গুজবকে সত্যি ভেবে আতঙ্কিত হন এবং যদি বিশ্বাস জন্মে যায় রাষ্ট্র এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলো এই দুর্যোগ থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে না তখন যুক্তিজ্ঞান হয়তো তেমন আর কাজ করে না। তাই নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে তারা হিংস্র হতে পরে।

এ কারণেই আমাদের মনে হয় গণপিটুনিতে যুক্ত কয়েকজনকে শাস্তি দিলেই সমস্যার সুরাহা হবে না। সঠিক বার্তা ও আচরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। তাদের মনে নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে আস্থার জায়গাটি তৈরি করতে হবে।

মানুষ যদি মনে করে অন্যায়কারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে বহাল তবিয়তে থাকবে, যদি বিশ্বাস জন্মে অর্থের বিনিময়ে সব অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় তাহলে মানুষের ভেতর কোনো আস্থার জায়গা তৈরি হবে না। এ অবস্থায় সামাজিক অস্থিরতা প্রশমন করা কঠিন হবে। বিভ্রান্ত মানুষ আরও অন্ধকারের দিকে ছুটবে।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

শিরোনাম:

স্টেশনে যাত্রীরাই কাটতে পারবেন ট্রেনের টিকিট
এপ্রিলের ১৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ডলার
পুলিশকে সাহায্য করবে ক্রাইম জিপিটি!
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর