শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন: দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন: দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার

সংগৃহীত

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘুচতে যাচ্ছে উত্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর সঙ্গে বগুড়ার রেলপথের দূরত্ব যেমন কমবে, তেমনি সম্প্রসারিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। গতি আসবে জীবনযাত্রায়। প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর এ রেলপথ নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে বগুড়া জেলা প্রশাসন।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ এখন আর উত্তরাঞ্চলবাসীর স্বপ্ন নয়; বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বছরের শুরুতে নির্মাণকাজ শুরু হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর সঙ্গে বগুড়ার রেলপথের দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার; সময় বাঁচবে তিন থেকে চার ঘণ্টা।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব-সংবলিত চার ধারার নোটিশ ভূমি মালিকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। পাশের জেলা সিরাজগঞ্জেও জমির মালিকদের নামে নোটিশ প্রস্তুতের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হবে।

রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরুর খবরে শুধু বগুড়া নয়; আশপাশের জেলার মানুষের মাঝেও উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে ঘুচতে যাচ্ছে উত্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও রেলওয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বগুড়ার সঙ্গে সিরাজগঞ্জের সরাসরি রেলপথ নেই। অথচ দুই জেলার মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। নতুন রেলপথ চালু হলে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব। বর্তমানে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি রেলপথ না থাকায় এ অঞ্চলের ট্রেনগুলোকে সান্তাহার, নাটোর ও পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করতে হয়। বাড়তি পথ ঘুরতে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় হচ্ছে তেমনি বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। বগুড়া থেকে যেখানে সড়কপথে ঢাকায় পৌঁছাতে লাগে ছয় ঘণ্টা, সেখানে ট্রেনে যেতে লাগে ৯-১০ ঘণ্টা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলপথে অন্তত তিন-চার ঘণ্টা সময় বাঁচবে। একইসঙ্গে বছরে আন্তঃনগরের দুটি ট্রেনে জ্বালানি সাশ্রয় হবে চার কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশি।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ (ব্রড গেজ ও মিটার গেজ) নতুন রেলপথ নির্মাণে ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে বগুড়ার সীমানা পর্যন্ত অধিগ্রহণ করা হবে ৪৭৯.১৫ একর। বাকি ৪২০.৬৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হবে সিরাজগঞ্জ জেলায়। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১,৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় ঋণের অর্থে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় পাঁচ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে তিন হাজার ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেবে ভারত। শুরুতে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগ এবং নকশা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিলম্বের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে তারা।

প্রকল্পের আওতায় ডুয়েল গেজের দুটি রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো- বগুড়ার ছোট বেলাইল এলাকা থেকে সিরাজগঞ্জের এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার এবং অপরটি বগুড়ার কাহালু স্টেশন থেকে রাণীরহাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার। মূলত সান্তাহারের দিক থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে সান্তাহার হয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুরগামী ট্রেনগুলো যাতে বগুড়া স্টেশনকে এড়িয়ে সরাসরি চলাচল করতে পারে, সেজন্য কাহালু-রাণীরহাট রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি রেলপথ মিলিত হওয়ার কারণে বগুড়া শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে রাণীরহাটে একটি জংশনও নির্মাণ করা হবে। আরেকটি জংশন হবে সিরাজগঞ্জে। এছাড়া নতুন রেলপথের জন্য দুই জেলা সীমানায় আরও ছয়টি স্টেশন করা হবে। সেগুলো হলো–শেরপুর, আড়িয়া বাজার, ছোনকা, চান্দাইকোনা, রায়গঞ্জ ও কৃষ্ণদিয়া।

বগুড়া জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা গাজী মুয়ীদুর রহমান বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়নে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভূমি মালিকদের চার ধারায় নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপর সাত ধারা ও আট ধারায় নোটিশ করা হবে। কোনো সমস্যা না হলে অধিগ্রহণ শুরু করব আমরা।”

এদিকে ভূমি মালিকদের চার ধারায় নোটিশ দেওয়া হবে জানিয়েছেন সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি হুকুম দখল শাখার সিনিয়র সহকারী কমিশনার সুইচিং মং মারমা। তিনি বলেন, “রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব জানিয়ে শিগগিরই ভূমি মালিকদের নোটিশ দেব আমরা।”

অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণকাজের জন্য টেন্ডার আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে বলে জানালেন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী। তিনি বলেন, “এজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শুরুতে মূল নির্মাণকাজ শুরু হবে।”

বগুড়া রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান বলেন, “প্রকল্পটির জন্য এ পর্যন্ত ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি বছর আরও ৪৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।”

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সিনিয়র সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রকৌশলী (লোকো) মো. কাজী সুমন বলেন, “বর্তমানে বগুড়ার ওপর দিয়ে রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেস সরাসরি ঢাকায় চলাচল করে। ১৪ বগির লালমনিরহাট ট্রেন চলাচল করতে প্রতি কিলোমিটারে ২.১৫ লিটার ডিজেল লাগে। এ হিসেবে বগুড়া থেকে ঢাকায় চলাচলে ট্রেনের রাস্তা ১১২ কিলোমিটার কমলে একটি ট্রেনের বছরে সোয়া দুই কোটি টাকার জ্বালানি (প্রতি লিটার ডিজেল ১২৫ টাকা ধরে) খরচ কমবে। তাহলে দুটি ট্রেনে খরচ কমবে অন্তত চার কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশি।”

বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলন বলেন, “বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি রেলপথ নির্মিত হলে রংপুর অঞ্চলের অন্তত আট জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট এবং নওগাঁরও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নতি হবে। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ প্রকল্প এ অঞ্চলের চেহারাই বদলে দেবে। মানুষের জীবনযাত্রায় গতি আনবে।”

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা, পর্যটন খাত, আবাসন ব্যবসা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বগুড়ায়। বিভিন্ন কারণে এই জেলার অনেক গুরুত্ব রয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতেও। সবগুলো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ দ্রুত নির্মাণ করা উচিত। এই রেলপথ হলে বগুড়ায় উৎপাদিত অনেক পণ্য ঢাকায় আনা নেওয়ায় সুবিধা হবে। রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা মানুষ ট্রেনযোগে ঢাকায় চলাচল করেন। এই পথে ট্রেন চালু হলে তারাও উপকৃত হবেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে বগুড়ায় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারতের তৃতীয় লাইন অফ ক্রেডিটের (এলওসি) ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সর্বশেষ: