সংগৃহীত
মানুষের চোখ সাধারণত দুঃখ, কষ্ট, ক্ষতি বা আনন্দে ভিজে ওঠে। কিন্তু এক ধরনের অশ্রু আছে, যা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান—এটি সেই চোখের অশ্রু, যা আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা, অনুশোচনা ও বিনয় থেকে প্রবাহিত হয়। ইসলামে এই অশ্রুর মর্যাদা অত্যন্ত উঁচু। কারণ এটি হৃদয়ের জাগরণ, ইমানের সতেজতা এবং আল্লাহর প্রতি গভীর সংবেদনশীলতার প্রকাশ।
আল্লাহর ভয়ে কাঁদা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
আল্লাহ মানুষের অন্তরকে সবচেয়ে ভালো জানেন। বাহ্যিক আমলের ওপরে তিনি হৃদয়ের অবস্থা মূল্যায়ন করেন। যখন বান্দা নিঃসঙ্গ কোনো মুহূর্তে, কেউ দেখছে না—এমন অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে কাঁদে—তা খাঁটি ইমানের প্রকাশ। এই অশ্রু পুরো দেহকে নরম করে, অহংকার ভেঙে দেয় এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।
কোরআনের দিকনির্দেশনা
কোরআনে আল্লাহ বলেন, ইমানদাররা যখন আল্লাহর আয়াত শোনে, তখন তাদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৮৩)
এটি প্রমাণ করে—অশ্রু মানে দুর্বলতা নয়; বরং আল্লাহর সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্কের লক্ষণ।
হাদিসে আল্লাহর ভয়ে কাঁদা
নবীজি (স.) বলেছেন, “দুই চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না—একটি সেই চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে; অন্যটি সেই চোখ, যা আল্লাহর পথে রক্ষাব্যূহে রাত কাটিয়েছে।” (তিরমিজি, হাদিস: ১৬৩৯)
অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে কাঁদা চোখকে বিশেষভাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এটি কিয়ামতের দিন তাঁর পক্ষ থেকে করুণা পাওয়ার বড় নিদর্শন।
কীভাবে এমন চোখ তৈরি হয়?
আল্লাহর ভয়ে কান্না কেবল আবেগের ফল নয়; এটি আসে গভীর চিন্তা থেকে।
১. কোরআনের আয়াত ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করা: যখন মানুষ আল্লাহর বাণী হৃদয়ে অনুভব করে, সৃষ্টি, বিচার দিবস, জাহান্নাম ও জান্নাতের বিবরণ নিয়ে চিন্তা করে—তখন হৃদয় নরম হয়।
২. নিজের ভুল ও পাপ স্মরণ করা: মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে নিজের দুর্বলতা উপলব্ধি করে, তখন অন্তরে লজ্জা জাগে এবং অনুশোচনার অশ্রু ঝরে।
৩. নিঃসঙ্গ সময়ে আল্লাহর সঙ্গে মুনাজাত করা: যখন কেউ অন্ধকার রাতে একা আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে, তখন হৃদয় সতেজ হয়, অন্তর নরম হয়।
৪. মৃত্যুচিন্তা ও আখিরাতের বাস্তবতা: মৃত্যু, কবর, হিসাব ও জবাবদিহিতার কথা মনে করলে চিত্র বদলে যায়, এবং চোখকে নরম করে।
এই অশ্রু কেন আল্লাহর কাছে এত প্রিয়?
১. এটি হৃদয়ের জীবন্ত থাকার প্রমাণ
২. এটি গুনাহ মুছে দেওয়ার শক্তিশালী মাধ্যম
৩. এটি আল্লাহর সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগের ফল
৪. এটি উপহাস, বাহাদুরি বা প্রদর্শনশীলতা নয়—শুধুই খাঁটি ইমানের প্রকাশ
নবীজি (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, তার চোখ থেকে বের হওয়া অশ্রু কিয়ামতের দিন অত্যন্ত মূল্যবান হবে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৯৯৮)
আল্লাহর ভয়ে কান্না হৃদয় বদলে দেয়
আল্লাহর ভয় মানে আতঙ্ক বা ভীত সন্ত্রস্ত থাকা নয়। বরং এর অর্থ—গভীর সম্মান, ভালোবাসা এবং তাঁর সামনে নিজের অক্ষমতা উপলব্ধি করা।
এই কান্না—
-
অহংকারকে ভেঙে বিনয়ী বানায়
-
মনকে পরিষ্কার করে
-
নফসকে কঠোরতা থেকে মুক্ত করে
-
আমলের প্রতি আগ্রহ জাগায়
-
দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বাড়ায়
হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, আল্লাহ তার দোয়া ফিরিয়ে দেন না।” (দলায়েলুন নুবুওয়াহ)
আল্লাহর ভয়ে কান্নার কিছু আমল
১. রাতে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট আয়াত নিয়ে ধীরে ধীরে নামাজ পড়া
২. নিজের জীবনের হিসাব নেওয়া—আমি কোথায় ভুল করছি?
৩. দোয়ায় বিনয় প্রকাশ করা—হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আমার কে আছে?
৪. কোরআনের তিলাওয়াতের সময় মানে বোঝার চেষ্টা করা
৫. নিঃসঙ্গ সময়ে আল্লাহর মহানত্ব ও করুণার কথা ভাবা
শেষ কথা
যে চোখ মানুষের সামনে কাঁদে, তা শুধু অশ্রু। আর যে চোখ আল্লাহর সামনে, শুধু তাঁর ভয় ও ভালোবাসায় কাঁদে—তা মুক্তি, ক্ষমা ও জান্নাতের চাবিকাঠি।
এমন চোখের অশ্রু মানুষকে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ আমাদের সেই সৌভাগ্য দান করুন—যে চোখ কাঁদবে না দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী কষ্টে, বরং কাঁদবে আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয় থেকে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন নরম হৃদয় দান করুন। আমিন।
সূত্র: প্রথম আলো














