সংগৃহীত
একটি নতুন গান এখন চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং কাইলি মিনোগের অমর কথার মতো—তুমি সেটা মাথা থেকে সরাতেই পারছ না।
কিন্তু যদি গানটি একটি রোবট বানিয়ে থাকে? অথবা শিল্পী নিজেই যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) তৈরি একটি সত্তা হয়? স্ট্রিমিং সাইটগুলোর কি বাধ্যবাধকতা আছে জানিয়ে দেওয়ার যে কোনো গান AI-জেনারেটেড? আর সত্যি বলতে—তুমি যদি গানটি পছন্দ করো, তা হলে এসব আদৌ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৯৭% মানুষ AI-জেনারেটেড গান চিনতে পারে না। তবে কিছু লক্ষণ আছে—যদি খেয়াল করো।
এখানে একটি দ্রুত গাইড দেও হলো।
লাইভ পারফরম্যান্স বা সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি নেই
গত গ্রীষ্মে AI-সংগীত বড় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে যখন The Velvet Sundown ব্যান্ডকে নিয়ে অভিযোগ ওঠে যে তারা নাকি AI-তৈরি, আর সেখান থেকেই তারা ভাইরাল হয়ে যায়।
কোনো রেকর্ড লেবেল নেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি খুবই কম—এমন একটি ব্যান্ড দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুইটি অ্যালবাম প্রকাশ করার পর হঠাৎ স্পোটিফাইতে লাখো শ্রোতা জোগাড় করে ফেলে—এতে সংগীতজগতে সন্দেহ বাড়তে থাকে।
প্রথমে ব্যান্ডটি অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে নিজেদের পরিচয় দেয় একটি “সিন্থেটিক প্রজেক্ট” হিসেবে—যা মানুষের সৃজনশীল নির্দেশনায় পরিচালিত, এবং AI-এর সাহায্যে সুর, কণ্ঠ ও ভিজুয়াল তৈরি করা।
তারা বলেছিল এটি প্রতারণা নয় বরং “শৈল্পিক উসকানি”, কিন্তু অনেক ভক্তই প্রতারিত মনে করেন।
ইন্টারনেট গোয়েন্দারা ব্যান্ডটির ছবি নিয়ে সন্দেহ করেন—যেখানে অতিরিক্ত এয়ারব্রাশ, অচেনা ব্যাকগ্রাউন্ড এবং কমলা রঙের উষ্ণ ফিল্টার দেখা যায়।
এদের কোনো লাইভ পারফরম্যান্সের রেকর্ড নেই—কোনো রিভিউ, কোনো কনসার্ট ভিডিও, কিছুই না। কোনো সাক্ষাৎকারও দেয়নি, এবং ব্যান্ড সদস্যদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টও নেই।
শিল্পীর বাস্তব জীবনের চিহ্ন বা সামাজিক উপস্থিতি খুঁজে দেখা—এটি একটি বড় সূচক। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা BBC-কে বলেন, দ্রুত উন্নত হওয়া প্রযুক্তির কারণে AI সংগীত চেনা ক্রমেই কঠিন হচ্ছে।
তবুও, কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো শুনলে সন্দেহ জাগতে পারে।
রক-হিট মিক্সারের ভেতর ঢুকিয়ে বানানো গান
প্রযুক্তি বক্তা এল. জে. রিচ স্মরণ করেন, পাঁচ বছর আগে AI একসঙ্গে মাত্র ৩ সেকেন্ডের সাউন্ড বানাতে পারত। এক মিনিটের অডিও বানাতে ১০ ঘণ্টা লাগত।
এখন একটি সম্পূর্ণ গান তৈরি হয়ে যায় এক লাইনের নির্দেশনায়—এবং এ কারণেই স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে AI-সংগীত বা "slop" ব্যাপকভাবে বাড়ছে।
রিচ বলেন, খুব মিষ্টি কিন্তু ফাঁপা, আবেগহীন, ফর্মুলা-ধর্মী গান—AI-এর লক্ষণ হতে পারে। ভোকালেও অনেক সময় শ্বাসহীনতা থাকে।
AI সাধারণত জেনেরিক ভার্স–কোরাস স্ট্রাকচারে থাকে, আর গানের শেষটাও তেমন সন্তোষজনক হয় না।
AI-র লেখা লিরিকও বেশিরভাগ সময় গ্রামাটিক্যালি পারফেক্ট। অথচ মানুষের লেখা অনেক সুন্দর লাইনই ব্যাকরণ মানে না—যেমন অ্যালিশিয়া কিজের “concrete jungle where dreams are made of” অথবা The Rolling Stones-এর ডাবল নেগেটিভ “I can’t get no satisfaction”।
রিচ বলেন, “গানে যদি আবেগ না থাকে, যদি টেনশন ও রেজোলিউশন না থাকে—তাহলে সেটা সন্দেহজনক। গল্পহীন গান মানুষের লেখা লাগে না।”
অন্য একটি লক্ষণ হলো অবাস্তব উৎপাদনশীলতা—অল্প সময়ে একাধিক সাউন্ডঅ্যালাইক অ্যালবাম বের হওয়া।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনা নেফ বলেন, কিছু শিল্পীর গান ৮০-র দশকের রক ব্যান্ডগুলোর মিশ্রণের মতো—“যেন ক্লাসিক রক হিট ব্লেন্ডারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
‘AI এখনো হৃদয়ভঙ্গের অনুভূতি জানে না’
কখনও গানটি খুবই ‘পারফেক্ট’ মনে হলে সন্দেহ হয়।
ভোকালে কোনো চাপ নেই, প্রোডাকশন অতিরিক্ত চকচকে।
ল্যানকাশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের টনি রিগ বলেন—
অদ্ভুত ফ্রেজিং, অস্বাভাবিক আবেগ প্রকাশ, এবং খুব সাধারণ বা পুনরাবৃত্ত লিরিকও AI-এর লক্ষণ।
তিনি বলেন, “AI কখনোই হৃদয়ভাঙা অনুভব করেনি… এটা শুধু প্যাটার্ন জানে। সংগীতের মানবিকতা আসে এর পেছনের গল্প থেকে।”
AI ভোকালে প্রায়ই স্লার শোনা যায়।
“p” বা “t” এর মতো ধ্বনি ঠিকমতো হয় না।
হঠাৎ ব্যাকিং ভোকাল এসে আবার হারিয়ে যায়—এটিও লক্ষণ।
তবে এগুলো ইঙ্গিত, প্রমাণ নয়।
কিছু শিল্পী নিজেরাই AI ব্যবহার করছেন
অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীও এখন AI টুল ব্যবহার করছেন।
তবে জানানো বাধ্যতামূলক নয়।
বিটলস—২০২৩ সালে জন লেননের পুরোনো ভয়েস আলাদা করে এনে “Now and Then” গানটি প্রকাশ করে।
ইমোজেন হিপ ও টিম্বাল্যান্ডের মতো শিল্পীরা আবার নিজেদের AI-পারসোনা তৈরি করেছেন।
ইমোজেন হিপ তার AI ভয়েস-মডেল ai.Mogen দিয়ে নতুন গান প্রকাশ করেছেন—যা তার কণ্ঠে ট্রেইন করা।
তিনি বলেন, পরিচিত শ্রোতারা তার প্রকৃত কণ্ঠের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য বুঝতে পারেন, কিন্তু সাধারণভাবে এটি মানুষের কণ্ঠের মতোই।
তিনি চান শ্রোতারা গানটি শুনে উপভোগ করুক, এবং যদি না জানে কিছু AI গেয়েছে—তাতে তাদের ভয়ও কমতে পারে।
তার মতে, গান তৈরিতে AI কতটা ব্যবহৃত হয়েছে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি—যেমন খাবারের উপকরণ লেবেলে লেখা থাকে।
স্বচ্ছতার পথে কিছু পদক্ষেপ
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর এখনো আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা নেই AI-তৈরি গান লেবেল করার।
ডিজার (Deezer) একটি AI ডিটেকশন টুল চালু করেছে এবং এখন AI-তৈরি গানগুলোকে আলাদাভাবে ট্যাগ করছে। তারা বলছে, প্ল্যাটফর্মে আপলোড হওয়া এক-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৫০,০০০ গান প্রতিদিন) পুরোপুরি AI-তৈরি।
স্পোটিফাইও “স্লপ” বা স্প্যাম সংগীত চিহ্নিত করতে নতুন ব্যবস্থা আনছে এবং চাইলে শিল্পীরা মেটাডাটায় জানাতে পারবেন গানে AI ব্যবহার হয়েছে কি না।
শেষ কথা—এসব সত্যিই কি গুরুত্বপূর্ণ?
যদি তুমি নতুন কোনো শিল্পীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাও—তাহলে সে AI কি না, তা কি সত্যিই জরুরি?
অনেকে মনে করেন, না—গান ভালো লাগলে সেটাই যথেষ্ট।
অন্যরা বলেন, শ্রোতার জানা উচিত তিনি কী শুনছেন।
Dua Lipa থেকে Elton John—অনেক শিল্পী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের গান ট্রেইনিং ডেটায় ব্যবহার নিয়ে।
LJ Rich বলেন, AI সংগীত অনেক “অদ্ভুত ও সুন্দর নৈতিক প্রশ্ন” তুলছে।
“যদি কোনো গান শুনে তোমার শরীরে কাঁটা দেয়—তাহলে সেটা AI লিখেছে কি না, আসলেই কি তাতে কিছু যায় আসে?”
সূত্র: বিবিসি













