শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনাকারী ভারত

শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনাকারী ভারত

সংগৃহীত

ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শিখ সম্প্রদায়ের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যা করতে ভারতীয় কর্মকর্তা বিক্রম যাদব নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভারতের গুপ্তচর সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা র-এর কর্মকর্তা ছিলেন বিক্রম যাদব। মার্কিন মিডিয়া সংস্থা ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। 

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্রম যাদব, যিনি বর্তমানে অন্য সরকারি সংস্থায় কর্মরত, তিনি পান্নুন এর নিউইয়র্কের ঠিকানাসহ সব বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছিলেন। যদিও এই হত্যার সঙ্গে যাদবের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পূর্বে কোনো কিছু জানা যায়নি। মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঐ হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। তবে সে সময় মার্কিন ফেডারেল কৌঁসুলিরা বলেছিলেন, নিউইয়র্কে শিখ নেতাকে হত্যা করতে ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেছেন ভারতীয় নাগরিক (৫২) নিখিল গুপ্ত।

গত বছরের ৩০ জুন চেক প্রজাতন্ত্রে নিখিল গুপ্ত গ্রেফতার হন। যুক্তরাষ্ট্র ও চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

নিখিলের পরিবার এরই মধ্যে জেল থেকে মুক্তি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের কাছে তিনি আবেদন করেন, তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দিল্লিতে বসবাসকারী তার পরিবারকে নিয়েও চিন্তিত নিখিল। ভারতীয় দূতাবাসে মাধ্যমে আইনি সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ঐ দাবি খারিজ করেছে আদালত। তবে এখনো আমেরিকার আদালতে বিচার চলছে নিখিলের। অন্যদিকে পান্নুনকে খুনের চেষ্টা নিয়ে আলাদা করে তদন্ত চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

পান্নুন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডারও নাগরিক। তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করতেন। তিনি ভারতে স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের জোরালো সমর্থক। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নানাভাবে জড়িত তিনি। ভারত সরকার তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

বাইডেন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, হোয়াইট হাউস প্রথম গত জুলাইয়ে শিখ নেতা পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা বলেন, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ অজিত দোভালের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে দোভালের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। সুলিভান আরো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়তা চায়, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। যদি আবার এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিআইএর পরিচালক উইলিয়ামস বার্নসকে তার ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি সিআইএ পরিচালককে ভারতে গিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবে না।  

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পান্নুনকে লক্ষ্য করে অপারেশনটি তৎকালীন র-এর প্রধান সামন্ত গোয়েল অনুমোদন করেছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, অজিত ডোভাল সম্ভবত র-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তবে এ ব্যাপারে মার্কিন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেননি।

ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে ডোভাল এবং গোয়েলের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে তাদের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

উত্তর আমেরিকায় ভারতীয় গুপ্তহত্যা চালানোর চক্রান্ত এবং র-এর ক্রমবর্ধমান আক্রমনাত্মক বৈশ্বিক অবস্থান নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়ার তিন ডজনেরও বেশি বর্তমান এবং প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।

কেন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করার ঝুঁকি নেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে একজন পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, কারণ তারা জানত যে তারা এটি থেকে পালিয়ে যেতে পারে।

ভারত যে উত্তর আমেরিকায় প্রাণঘাতী অভিযান চালাবে, তা পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হতবাক করেছে। বছরের পর বছর ধরে ভারতকে দ্বিতীয় শ্রেণির খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।  কিন্তু ভারত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার এই নতুন যুগে নিজেকে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে। ভারতকে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিচ্ছিন্ন করার সামর্থ্য রাখে না।

গত বছরের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি শিখ মন্দিরের বাইরে হত্যা করা হয় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর কে। হরদীপ হত্যার পর গত সপ্তাহে কানাডার পার্লামেন্টে বিস্ফোরক এক মন্তব্য করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এই হত্যায় ভারতের হাত আছে, এমন ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ পেয়েছেন তিনি। গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানকারী নেটওয়ার্ক ফাইভ আইসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযোগ করেন ট্রুডো। 

এই অপারেশনের সঙ্গেও যাদব জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। মোদী সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এরকম ১১ জন শিখ বা কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী গত দুই বছরে নিহত হয়েছে।

যদিও ওয়াশিংটন পোস্টের করা চাঞ্চল্যকর এই তথ্যকে স্বীকৃতি দেয়নি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেকথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা পোস্টের পক্ষ থেকে পাঠানো এই আর্টিকেলটির ব্যাপারেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

ভারতের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ভারত এখনও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি তদন্ত করছে এবং পান্নুন বিষয়টি ‘আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে সমানভাবে প্রভাবিত করে।’ জয়সওয়াল আরো বলেন, লক্ষ্য করে হত্যা করা ‘আমাদের পলিসি নয়’।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, তখন এ মামলাটিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

মার্কিন  বিচার বিভাগ এবং এফবিআই-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাদবকে বিচারের আওতায় জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিন সরকার যাদবকে শুধু একজন নামহীন সহ-ষড়যন্ত্রকারী, "CC-1" হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার নাম উল্লেখ করেনি।

বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা যাদবের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগের আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেছেন। 

এখন পর্যন্ত আমেরিকা একমাত্র নিখিল গুপ্তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছে। তাকে একজন ভারতীয় মাদক ও অস্ত্র পাচারকারী হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং চুক্তিতে হত্যাকারী ভাড়া করার জন্য দায়ী করা হয়েছে। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাইডেন প্রশাসন গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র রোধে পদক্ষেপ নিয়েছে। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা এই মাসে মোদি সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্কও করেছে।

সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ

সর্বশেষ: