সংগৃহীত
ঢাকার আদালতে ২০২২ সালের ৬ জুলাই সাভার বোট ক্লাবের কর্মকর্তা ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
২০২১ সালের ৯ জুন মধ্যরাতে সাভারের বোট ক্লাব কাণ্ডে মামলাটি করা হয়। তবে এর আগে ঐ রাতে পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে ঘটনার পাঁচদিন পর ১৪ জুন নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তার বন্ধু অমির নাম উল্লেখ করে সাভার থানায় একটি মামলা করেন পরীমনি। এতে চারজনকে অজ্ঞাত আসামি করেন তিনি। পরীমনির করা এ মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
তবে এরই মধ্যে ঐ রাতের ঘটনায় পরীমনির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পিবিআই। এতে পরীমনি ও তার সহযোগী জুনায়েদ বোগদাদী জিমির বিরুদ্ধে ভাংচুর, মারধর ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নাসির উদ্দিনের দায়ের করা এজাহারে হত্যাচেষ্টার কথা উল্লেখ থাকলেও তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যাচেষ্টার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। দণ্ডবিধি আইনের ৩২৬ ও ৫০৬ ধারায় অভিযোগ এনে সম্প্রতি প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন। প্রতিবেদনে আসামি পরীমনি ও তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের বিরুদ্ধে মামলার বাদী ব্যবসায়ী নাসিরকে মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আরেক আসামি ফাতেমা তুজ জান্নাত বনির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বোট ক্লাবের ঘটনার পর দেশবাসী আমাকে ভুল বুঝেছিল। কিন্তু এখন আপনারা দেখলেন পরীমনি নিজেই ঐ ঘটনার তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন বলে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আশা করি রায়ের দিন বিষয়টি আরো প্রমাণিত হবে।
বাদীপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম মোহাম্মদ সোহেল বলেন, মামলার এজাহারে হত্যাচেষ্টা, মারধর, ভাংচুর ও ভীতি প্রদর্শনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। চার্জশিটে শুধু হত্যাচেষ্টার অভিযোগ বাদে অন্য অভিযোগগুলো উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) ঢাকার সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে এ মামলার দিন ধার্য ছিল। এদিন পরীমনির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করে বাদীপক্ষ। আদালত শুনানি শেষে চার্জশিট গ্রহণ করে আগামী ২৫ জুন পরীমনি ও অন্য আসামি জিমকে আদালতে উপস্থিত হতে সমন জারি করেন।
মামলার সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ জুলাই নাসির উদ্দিন মাহমুদ আদালতে মামলা করার পর ১৮ জুলাই ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সিআইডি প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব করায় পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মামলার ঘটনার সাক্ষী তুহিন সিদ্দিকি অমির সঙ্গে পরীমনির সহযোগী জুনায়েদ বোগদাদী জিমির পূর্ব পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। এরই সূত্র ধরে ২০২১ সালের ৮ জুন তুহিন সিদ্দিকি অমির সঙ্গে পরীমনি ও তার সহযোগী জিমিসহ চারজন জিপ গাড়িতে করে রাত ১২টা ২২ মিনিটে সাভারের ঢাকা বোট ক্লাবে আসেন।
ক্লাবের দোতলায় উঠে পরীমনি একটি এক লিটারের ব্লু-লেবেল মদের বোতল অর্ডার করেন। পরীমনি এবং তার সঙ্গে থাকা জিম ও বনি নিমিষেই সেই বোতলের মদ পান করে বোতল খালি করে ফেলেন এবং আরেকটি বোতলের অর্ডার করেন। তারা ঐ বোতলের আংশিক মদ পান করেন।
আড্ডার একপর্যায়ে বোটক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য নাছির উদ্দিন মাহমুদকে আরো দুইজন ব্যক্তির সঙ্গে বসা দেখতে পান অমি। তখন বোড ক্লাবের এ কর্মকর্তা (অমি) পরীমনিকে নিয়ে নাছিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর তাদের টেবিলে বসে পুনরায় মদ্যপানসহ গল্পগুজব করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর নাছির মাহমুদ চলে যেতে চাইলে পরীমনির অনুরোধে ফিরে এসে পুনরায় তার টেবিলে বসেন। ড্রিংকস শেষে পরীমনি ওয়েটারকে আরো এক লিটারের তিন বোতল ব্লু লেবেল মদসহ দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দেওয়ার জন্য অর্ডার করেন। ওয়েটার তখন পরীমনিকে দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দিলেও ব্লু লেবেল মদের বোতল স্টকে না থাকায় পার্সেল দিতে পারেননি।
তখন পরীমনি ডিসপ্লেতে থাকা একটি ব্লু লেবেল বোতল পার্সেল করে দিতে বললে ওয়েটার জানান বোতলটি বিক্রির জন্য নয় এবং ক্লাবের মেম্বার ছাড়া পার্সেল দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরীমনি জোর করে ঐ বোতল নিতে চান এবং টেবিলে হট্টগোল করতে থাকেন। পরীমনি উত্তেজিত হয়ে দুই-তিনটি ব্যাংক কার্ড দেখিয়ে বলেন, ‘আমি কি ফকিরনি? আমার বিল আমি পরিশোধ করব। আমি এটা নেবই।’
তখন পরীমনির সঙ্গে থাকা ফাতেমা বনি ও জিম তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে তাদেরকে চড়-থাপ্পড় মারেন পরীমনি। একপর্যায়ে পরীমনি খুবই উত্তেজিত হয়ে টেবিলের উপর থাকা গ্লাস, অ্যাশট্রে, বোতল ফ্লোরে এদিক ওদিক ছুঁড়তে থাকেন। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পরীমনিকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরীমনি আরো ক্ষেপে গিয়ে একটি অ্যাশট্রে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারেন। যা তার ডান কানের উপরে মাথায় লাগে। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবে পরীমনিকে সঙ্গে করে আনায় অমির উপর রেগে যান এবং বলেন, ‘এরকম বেয়াদব মহিলা নিয়ে কেন ক্লাবে আসেন, কাল আপনার নামে নোটিশ হবে। এক্ষুণি এদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যান।’ তখন জিম তেড়ে এসে বাদী নাছির মাহমুদকে গালমন্দ করতে করতে ২/৩টা কিলঘুষি মারেন। এরপর আবারো পরীমনি বারের ভেতরে যত্রতত্র গ্লাস ছুড়ে ভাঙচুর করতে থাকেন। একটি গ্লাস নাছির মাহমুদের বুকে লাগলে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। তখন নাছির মাহমুদ বোট ক্লাব ত্যাগ করে চলে যান।
এরপর পরীমনি ক্লাবে তাদের খাওয়া দুই বোতল ব্লু লেবেলের দাম ও পার্সেলে নেয়া দুই বোতল ওয়াইনের দাম পরিশোধ না করেই ক্লাব থেকে চলে যান। এই চারটি বোতলের দাম ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এছাড়া ক্লাবের বারের ভেতরে গ্লাস, অ্যাশট্রে, বোতল ভাঙচুর করায় আনুমানিক ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।
এ মামলার এজাহারে বাদী নাসির উদ্দিন উল্লেখ করেছিলেন, পরীমনি ও তার সহযোগীরা বাদীকে মারধর ও হত্যার চেষ্টা করেছেন এবং বোট ক্লাবে ভাঙচুর করেছেন। এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পরীমনি সাভার থানায় বাদী নাসির উদ্দিনসহ দুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে মামলা করেন।
বোড ক্লাবের ঐ রাতের ঘটনার পর পরীমনি তার নিজ ফেসবুক পেইজে তাকে হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে ঘটনার পাঁচদিন পর ২০২১ সালের ১৪ জুন ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তার বন্ধু অমির নাম উল্লেখ করে এবং চারজনকে অজ্ঞাত আসামি করে পরীমনি সাভার থানায় মামলা করেন।
ঐ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নাসিরসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।
এরপর ২০২২ সালের ১৮ মে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯-এর বিচারক হেমায়েত উদ্দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের সময় নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন নাসিরসহ অন্য আসামি। বর্তমানে মামলাটিতে বাদী পরীমনির সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ
