শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বদলে যাবে হাওরের কৃষি

বদলে যাবে হাওরের কৃষি

সংগৃহীত

সারা দেশে যে পরিমাণ বোরো ধান চাষ হয়, তার প্রায় ১৯ শতাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। চলতি বোরো মৌসুমে হাওরভুক্ত ৭ জেলায় মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৫৭ হেক্টর। বোরো ধান এই অঞ্চলের কৃষকের প্রধান ফসল। মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ফলন বেশ ভালো। হাওরের কৃষকের আতঙ্কের নাম আগাম বন্যা, পাহাড়ি ঢল। ধান রোপণ, নিড়ানি, সার বা কিটনাশক প্রয়োগসহ হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যখন ধান গোলায় তোলার কথা, তখনই আসে আগাম বন্যা বা পাহাড়ি ঢল। চোখের সামনে তলিয়ে যায় কৃষকের ধান।

দীর্ঘকাল থেকে হাওরে এমনটিই হয়ে আসছে। যদিও গত দুই তিন বছর হলো অনেকটা নিরাপদেই ঘরে ধান তুলতে পারছেন কৃষক। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা বা নানা দুর্যোগের আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে হাওরভুক্ত সাত জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনো ও বি-বাড়িয়ায় বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘হাওর অঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে ফ্লাড রিকনস্ট্রাকশন এমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রজেক্ট (ফ্রিপ)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ২৫৬ কোটি টাকা বিদেশী (এডিবি) ঋণে। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৬ সালের মার্চ মাসে।

ফ্রিপ প্রকল্প পরিচালক ড. মো: তৌফিকুর রহমান বলেন, সম্প্রতি উদ্ভাবিত ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত হাওরাঞ্চলে সম্প্রসারণ এই প্রকল্পের লক্ষ্য। তিনি বলেন, যদি আমরা ১০-১৫ দিনের আগাম জাত দিতে পারি, তাহলে বন্যা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এ জন্য নানা টেকনোলজি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পিডি বলেন, ব্রি ধান ৮৯, ৯২, ১০০, ১০২ এবং বিনা ধান ২৫ বর্তমান সময়ে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে বেশি ধান উৎপাদন হয়। ব্রি ধান ২৯ জাতের চেয়েও এসব জাতে ফলন বেশি। এ ছাড়া বন্যা সহনশীল ধান জাত ব্রি ৫১, ৫২, ৭৯ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলের মধ্যে বারি সরিষা ১৪ ও ১৭, ভাসমান বেডে সবজি চাষসহ বিভিন্ন ফসল সম্প্রসারণ করা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। কৃষকের ক্যাপাসিটি ডেভলপ, টেকনোলজি ট্রান্সফার, ক্ষুদ্রসেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এগ্রিকালচার মেকানাইজেশনে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান ড. মো: তৌফিকুর রহমান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সুনামগঞ্জ জেলা উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম নয়া দিগন্তকে জানান, হাওর ও নন হাওর মিলিয়ে এ জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টরের বেশি। আশা করছি ৯ লাখ ১৮ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, একসময় বিআর ২৮ ও ২৯ ধান জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হতো। রোগবালাই আক্রমণ করে তাই কৃষককে এটির পরিবর্তে অন্য ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এতে আমরা সফল হয়েছি। এবার জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে ব্রি ধান ৮৯। মোট ৩৪ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। বিআর ২৯ ধান ৩১ হাজার ও ২৮ ১৮ হাজার হেক্টর (দু’টি মোট ৪৯ হাজার হেক্টর), ব্রি ৮৮ ধান ২১ হাজার ৮০০ হেক্টর, ব্রি ৯২ ধান ২২ হাজার ৭৬৩ হেক্টর অন্যতম।

আকস্মিক বন্যা হাওরাঞ্চলের ফসল ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন আকস্মিক বন্যা ও প্লাবিত বন্যা হাওর সমৃদ্ধ অঞ্চলের ফসল ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তা মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত ও টেকসই ফসলের জাত, প্রযুক্তি এবং বিকল্প ফসলের চাষ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে বন্যা সংশ্লিষ্ট অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুযায়ী হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ৭টি জেলার ৬৫টি উপজেলায় প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- টেকসই পদ্ধতি ও প্রযুক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে ফসলের নিবিড়করণ, বহুমুখীকরণ, উন্নত সেচ ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা; জলবায়ু স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে বন্যা সহিষ্ণুু ফসল উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; আধুনিক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসলের শস্যনিবিড়তা ১৭৪ শতাংশ থেকে ১৭৬ শতাংশ অর্থাৎ ২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা; কৃষক এবং ডিএই কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং ডিএইর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কৃষক গ্রুপ গঠন, ১টি কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাম অফিস ভবন নির্মাণ, ২টি এগ্রিকালচার মাল্টিপারপাস সেন্টার নির্মাণ অন্যতম প্রকল্পের কার্যক্রম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং আইসিটি উইং) মো: রেজাউল করিম বলেন, উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের ফলে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে এবং ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ অদ্ভুতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি এ প্রকল্পের জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল বিভিন্ন ফসল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাওরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে স্মার্ট দেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশের কৃষি হচ্ছে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা একটি সংগ্রামের নাম। হাওর এলাকায় ফসল উৎপাদনে আগাম ও আকস্মিক বন্যা, সেচের পানির অপ্রতুলতা ইত্যাদি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। প্রকল্পটির আওতায় সময়োপযোগী কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগ, কৃষকদের গ্রুপে সম্পৃক্তকরণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সর্বশেষ টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এলাকার শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভিশন ২০৪১ পূরণের লক্ষ্যে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সহায়ক হবে।

এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ও এডিবির অর্থায়নে ফ্লিপ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে হাওর এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে অনবাদি জমি আবাদের আওতায় আনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে পারবে। ডিএইর ডিজি আরো বলেন, ফ্লিপ প্রকল্প হাওর অঞ্চলের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং টেকসই জীবিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সূত্র: নয়া দিগন্ত

সর্বশেষ: