শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস

নিজের মতো বই পড়ার অধিকার

নিজের মতো বই পড়ার অধিকার

সংগৃহীত

বিশ্বে বহু দিবস পালিত হয়। জলাভূমি, পরিবেশ, নদী, মৃত্তিকা, পানি, স্বাস্থ্য, বসতি, পাখি, বাঘ, বন কিংবা মেধাস্বত্ব বিষয়ে। বই দিবসও এমনি। ১৯৯৫ সনে জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব বই ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ঐ বছর দিনটি উইলিয়াম শেকসপীয়র এবং ইনকা গার্সিলাসো দ্য ল্য ভেগাসহ অনেকের জন্ম ও মৃত্যুদিন। দুনিয়ার নানা দেশ নানাভাবে বই দিবস পালন করে। যদিও পৃথিবীর বেশকিছু দেশ নিজেদের মতো করে বছরে একদিন বই দিবস পালন করত। তবে ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস ঘোষণার পর দুনিয়াজুড়ে বহুজন নানাভাবে দিনটি পালনের চেষ্টা করে। একইসাথে ‘ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অন বুকস ফর ইয়াং পিপল’ দোসরা এপ্রিলকে ‘বিশ্ব শিশুতোষ বই দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

২০২৪ সালের বিশ্ব বই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘তোমার মতো পড়’। আসলেই আমরা কি আমাদের মতো পড়তে পারি? ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তান উপনিবেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্যোগ, মহামারি, সবুজ বিপ্লব, দূষণ কিংবা সমাজে বিদ্যমান কাঠামোগত বৈষম্য এবং নিরন্তর শ্রেণি প্রতিরোধ কী আমাদের পাঠপদ্ধতি ও পাঠাভ্যাসকে প্রভাবিত করে না?

আমরা চাইলেও কি আমাদের মতো করে বই বাছাই করবার স্বাধীনতা রাখি কিংবা এমন পরিস্থিতি কী চারধারে জারি আছে। কিন্তু প্রতিটি শিশু কী যুব বা প্রবীণের অধিকার আছে তার নিজের মতো করে পড়বার। বাছাই এবং পড়ার স্বাধীনতা। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অভিভাবক, বিদ্যায়ন, মিডিয়া, বাজার কিংবা প্রবল ক্ষমতার ব্যবস্থা শিশুদের ওপর জোর করে অচেনা অজানা বইয়ের ভাণ্ড চাপিয়ে দেয়। এই পরিস্থিতি ও বাহাদুরিকে প্রশ্ন করা জরুরি। প্রতিটি মানুষের তার নিজের মতো করে বই পড়ার অধিকার সুরক্ষিত হোক।

নিজে বানান করে পড়া আমার প্রথম বই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। ছোটবেলায় পারিবারিক পাঠ্য ছিল নজরুলের সঞ্চিতা, রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সুকান্ত ও সুকুমার সমগ্র। তখন সবে স্কুলের গণ্ডিতে ঢুকেছি। বড় বোনের বই পড়ার বাতিক ছিল, মা’র কাছ থেকে পাওয়া। বাবার ছিল ট্রাংক ট্রাংক বই। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকার সময়ই ডারউইনের দুনিয়া কাঁপানো অরিজিন অব স্পিসিস বইটির প্রথম দিকের সংস্করণ ধরে দেখার মহাসৌভাগ্য ঘটেছিল। আলেক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ মা পড়ে শোনাতেন দুপুরবেলার ভাত ঘুমের আগে। বিশ্ব সাহিত্য, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ছাড়াও ঘরভর্তি ছিল যোগব্যয়াম আর হোমিওপ্যাথির বই। মার্কস থেকে লেনিন প্রগতি প্রকাশনীর লাল নীল সাদা কালো কত কিসিমের বই আজ নামও ভুলে গেছি।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল দেবীপ্রসাদের যে গল্পের শেষ নেই। বসুমতী, উদয়ন, শিশু, পাতাবাহার, দেশ, বেগম, বিচিত্রা এসব সাময়িকীর পাশাপাশি দৈনিক সংবাদ তখন উল্টেপাল্টে দেখা শুরু করেছি। ঠাকুরমার সাথে রামায়ণ আর মহাভারত পাঠের আসরে গেলেও মগজ পড়ে থাকতো মরুতীর্থ হিংলাজ কি মহাপ্রস্থানের পথে। পথের পাঁচালী আর চাঁদের পাহাড়ের ভেতর কোনটা আগে শেষ করেছি খেয়াল নেই। আমাদের বোন তখন জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশদিন শেষ করেছে। আমিও হাতে নিয়েছিলাম, টানেনি।

যখন জানলাম আমার নামের প্রথম অংশটি গোর্কির মা উপন্যাস থেকে নেওয়া সেখানেও হাত দিয়েছিলাম। মার হাতে তখন বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম আর বাবার ইউলিসিস। বাসায় বাংলা পঞ্জিকার চল এখনো আছে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন ঘরদোরের পাশাপাশি বইপত্র, ট্রাংক, আলমিরা সব সাফসুতরো করা হতো। টাল টাল বই রোদে দেয়া হতো। বইয়ের সারির ভেতর উঁকি মারত নানা মাপের আচারের বয়াম। রোদ পোহানো বইগুলি ঝেড়ে মুছে রাখার সময় আমাদের বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসত। দেখাদেখি শেষ হতো না। ইংরেজি বইগুলো আমায় একদমই টানত না। বাবার কাছে ঐগুলোই ছিল যক্ষের ধন।

আরব্য রজনি, মহাভারত, ওডিসি আর ইলিয়াড পড়ার পর আমিও নিঃসন্দেহে আমার বোনের মতোই বইয়ের প্রেমে পড়ে যাই। চৈত্রসংক্রান্তির পরের দিন নববর্ষকে আমরা বলি ‘মাস পয়লা’। বৈশাখের প্রথম দিন ঘরের দরজায় কাঁচা আম পাতা সাজিয়ে ঝোলানো হয়, তাতে দেওয়া হয় রক্তলাল সিঁদূর। নতুন পঞ্জিকাকে কাঁচা হলুদের কষ ও সিঁদূর মাখানো হয়। বইয়ের ট্রাংক কি আলমিরা সর্বত্র তেল-সিঁদূরের ছাপ।

আমরা বড় হয়েছি ছোট্ট মফস্বল নরসিংদীতে। মোহন সিরিজ, দস্যু বনহুর আর চিত্রালী পত্রিকা পড়ত বড়রা। ঐসব তখন শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ। অধ্যাপনার পাশাপাশি বাবার ছিল চাপাতার দোকান। মুন্না টি হাউস। গ্রাম থেকে আসা আত্মীয় পরিজন যারা ঐ দোকানে আসা যাওয়া করত তারাই নিষিদ্ধ বই পড়ার অধিকার পেয়েছিল। শুধু শুনতাম রেলস্টেশনের বইয়ের দোকানে ঐসব বই বিক্রি হয়। পঞ্চম শ্রেণির পরেই আমাদেরকে বাসা পাল্টাতে হলো। বইয়ের যেমন জগাখিচুড়ি, আমাদের বাসাটাও ছিল হিন্দু-মুসলিম-বাঙালি-আদিবাসী আর নানা বয়সের এক মাঝারি বাজার। জীবনের প্রথম যেদিন রেল স্টেশনের সেই নিষিদ্ধ বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়াই, মনে হয় এক আস্ত রেলপথ আমাকে ছিঁড়েখুড়ে গেছে। টিফিনের পয়সা জমানো শুরু তখন থেকেই।

বোন আর আমি। আমাদের ছোট ভাই তখনো বইয়ের নাগাল পায়নি। প্রগতির পর সেবা প্রকাশনী। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন রেলস্টেশনের সেই নিষিদ্ধ বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। জুল ভার্ন থেকে বারোজ, দ্য লিটিল হাউস অন দ্য প্রেইরি থেকে ড্রাকুলা, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে মার্ক টোয়েন, ফ্রাংকেনস্টাইন থেকে বারমুডা ট্রায়াংগল। আমাদের বাসায় কখনোই পাঠ্যবইয়ের ভেতরে লুকিয়ে বা আলাদা মলাট মেরে কোনো বই পড়তে হয়নি। এমনকি বয়ঃসন্ধিকাল ও শারীরবিদ্যার বইগুলোও সযতনে আমাদের পড়তে দেওয়া হয়েছে। লোলিটা, প্রজাপতি, বিবর বইগুলো যখন পড়েছি তখন হুমায়ূন আহমেদ, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব, সুনীল আর মিলনের ভরা জোয়ার।

এমনও হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদের নতুন কোনো বই বন্ধুরা ভাড়া দিয়ে পড়ে আবার দোকানে জমা দিয়েছি। পরপর চিনতে শিখি হুমায়ুন আজাদ, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, দেবেশ রায়, দ্বিজেন শর্মা, আবুল বাশার, প্রবীর ঘোষ, সত্যজিৎ রায়, সৈয়দ শামসুল হক, জীবনানন্দ থেকে সিকদার আমিনুল হক। বিনয় মজুমদার থেকে পুর্নেন্দু পত্রী, শংখ ঘোষ কি জয় গোস্বামী। বুঝতে শিখেছি প্রেমেন্দ্র মিত্র, উপন্দ্রে কিশোর, বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জসীমউদদীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ- এরা অবশ্য পাঠ্য।

বাবার ছিল অভিধান সংগ্রহের নেশা। তখন শুধু বই রাখার জন্য আমাদের নতুন দুটি স্টিলের আলমিরা বানানো হয়েছে। আগের দুটি বাঁশের শেলফ সব মিলিয়ে ভাইবোনদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে আমরা চালু করি ‘সুপাসো পাঠাগার’। পিশিমনির বাড়িতে, সুনামগঞ্জের বলরামপুরে কংকাবতী পাঠাগারটির বয়স ছিল মেলা। আমাদেরও বেশকিছু পাঠক হয়েছিল। বাবার মতো আমার বোনও যখন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার পরিচয় ঘটে টলস্টয়, কাফকা, সার্ত্রে, জর্জ ওরওয়েল, কামু, হেমিংওয়ের সাথে। যদিও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি তখন চারু মজুমদার আর আদিবাসী জীবন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উঠি। জীবনে প্রথম সমাপ্ত রচনাবলির নাম ‘বেগম রোকেয়া’।

আমরা বড় হয়েছি নানা মাপের, নানা কিসিমের বইয়ের ভেতর দিয়ে। আদর্শলিপি থেকে শুরু করে নামতা। কয়েক পাতার চ্যাপ্টা মাপের বই। স্কুলের বইগুলোর মাপের সাথে অন্য বইয়ের মিল ছিল না। পঞ্জিকাটি আবার অন্যরকম। অভিধানগুলোর সাথে কৃষ্ণের শত নাম, খনার বচন কি পাঁচালী বইগুলোর শরীর স্বাস্থ্যে কতই না অমিল। গীতা, বেদ, বাইবেল, কোরান শরীফ কি ত্রিপিটক গ্রন্থগুলোর আলাদা মর্যাদা। লাল সালু কাপড়ে মুড়িয়ে ঘরের সবচে পবিত্র স্থানে এদের স্থান। স্নান করে বাসী কাপড় পাল্টিয়ে কাঠদানিতে নিয়ে এসব পড়তে হতো। যাতে পা না লাগে, থুথু না ছিটকে পড়ে এমনতর কত সাবধানতা! তাবিজের মতো ছোট্ট কোরান শরীফ, তালপাতায় লেখা পুঁথি আর বিশাল আকারের মানচিত্রের বইগুলো দেখে বইদেখা বিষয়ে প্রথম জ্ঞান হারাই।

বাবা চালু করেছিলেন বই উপহারের, বিয়ে কি জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠানে। খুব কাছ থেকে খেয়াল করেছি কেউ তা মন থেকে মেনে নেয়নি। বেলা দে’র গৃহিণীর অভিধান বইটি যখন বাসায় প্রথম আসে, তখন আশপাশের অনেকেই বাসায় ভিড় জমাতে শুরু করে। তো বই আর বই। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। বাংলাদেশের এক বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাকরণে।

আমাদের একবিন্দু অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি, বইয়ের দুনিয়া শরীর-মাংস-মজ্জার এক জীবন্ত চলমানতা। খুব বেশিদিন হয়নি দুনিয়া ভার্চুয়াল বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। এখন বইয়ের দুটি ধরন। পাতা ভরা বই আর ভার্চুয়াল বই। অনেকে বলেন ‘সফট আর হার্ড কপি’। ভার্চুয়াল বইগুলো আবার ‘ই-বুক’ নামেই পরিচিত। সময়ের চাপে আমারও এমনতর বেশকিছু বইয়ের রসদ আছে। কিন্তু ভার্চুয়াল বইয়ের সাথে কাঁচা হলুদ কি রক্তলাল সিঁদুরের কোনো ওঠাবসা নাই। ইঁদুর-ছারপোকার যন্ত্রণা নাই। ময়লা সাফসুতরোর টালমাটাল নাই। আমাদের অনেক বই দাদুর ছিল, বাবার হাতে এসেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বইয়ের এই বিচিত্র যাত্রাপথ কোনোভাবেই কী ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সম্ভব?

ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বইয়ের অন্য মানে, অন্য ব্যাকরণ। বইয়ের স্বভাব ও আচরণ সেখানে ভিন্ন। লেখক, প্রকাশক, পরিবেশক, ক্রেতা, পাঠক সব মিলিয়ে বই ধরে রেখেছে পেশা ও উৎপাদনের এক জটিল সমাজ। এ সমাজে সকলে সকলকে চেনে না। কার বাঁশ বাগানের বাঁশ কাগজকলে যায়, রঙের কারখানায় কার ঘাম ঝরে, কে বই বাঁধাই করে, কে থাকে রাতভর ছাপাখানায় এসব খবর কে রাখে? একটি বই তো আর কেবল লেখক আর পাঠকের একতরফা সম্পর্ক নয়। বিস্তর মানুষের ঘাম আর স্মৃতি আখ্যান নিয়ে একটি বইয়ের জন্ম হয়। আমরা কি দুই মলাটের ভেতর কাগজের পাতায় ছাপানো অক্ষরকেই কেবল বই হিসেবে জানি? কোনোভাবেই নয়। আমাদের কাছে বই বিদ্যা ও জ্ঞান বহন করে। আর তাই বই পায়ে লাগলে আমরা তার কাছে ক্ষমা চাই, সালাম জানাই।

শৈশবে বইয়ের ভেতর বিদ্যাপাতা নামে একপ্রকার ফার্ন গাছের পাতা রাখতাম। এসব পাতা রাখলে নাকি বইয়ের জ্ঞান বিদ্যাপাতার ভেতর দিয়ে মগজে চলে আসে। এভাবেই বিদ্যা জীবন্ত থাকে গাছের পাতা আর বইয়ের পাতার রসায়নে। বই জীবন্ত থাকে বইয়ের পাঠকের ভেতর দিয়ে। পাঠকের নানা সময়ের স্মৃতিগন্ধ, ঝাঁঝ, রক্ত, সাহস লেগে থাকে বইয়ের পাতায় পাতায়। নিজের মতো করে বই পড়বার মতো তৎপরতা জাগিয়ে রাখি আসুন, চারধারে, নিজের ভেতর।

সূত্র: কালের কন্ঠ

সর্বশেষ: