রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

ডলারের দর কমছে কেন?

ডলারের দর কমছে কেন?

সংগৃহীত

এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধান বিদেশি মুদ্রা ডলারের দর এক টাকা পর্যন্ত কমেছে; যার পেছনে বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেছেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ব্যাংকগুলো ১২১ টাকা ৮৫ পয়সায় ডলার বিক্রি করেছে। আট দিন আগে ২ জুলাই এ দর ছিল ১২২ টাকা ৮৫ পয়সা। মূলত ওই দিনের পর থেকে ডলারের দর একটু একটু করে কমতে থাকে এবং ১০ জুলাই তা ১২২ টাকার নিচে নামে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের অর্থ পেতে ১৪ মে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়ার পরও তা না বেড়ে দেড় মাস পর উল্টো কমছে।

আগের চেয়ে শর্ত শিথিল করার পর বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা কাটিয়ে প্রথমে কিছুদিন একই জায়গায় ঘুরপাক খাওয়ার পর গত দেড় সপ্তাহ থেকে তাতে কিছুটা নিম্নমুখী ভাব দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কথা বলছেন ব্যাংকাররা। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমায় সেভাবে ডলার খরচ হচ্ছে না বলেও তুলে ধরেন তারা।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার রেমিটেন্সের দর দেওয়া হয়েছে ১২১ টাকা। এক সপ্তাহ আগে দেওয়া হয়েছিল ১২২ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তরা বলছেন, মাঝে কয়েক মাস রেমিটেন্সে উল্লম্ফনের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ের প্রবাহ বাড়ার কারণে ডলার বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। এর সঙ্গে জুনে আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে অর্থ ছাড় হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বড় অঙ্কের ডলার আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খানও মনে করছেন, এসব কারণে ডলারের দর আগের চেয়ে কমেছে।

এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খানও ডলারের সরবরাহ বাড়ার ইতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরে বলেন, ডলারের দর কমলে আমদানির খরচ কমবে। তাতে মূল্যস্ফীতি কমাতেও ভূমিকা রাখবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ডলারের জন্য বেশ কিছুদিন হাহাকার ছিল। এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খেত। এখন ব্যাংকে ডলারের যোগান ভালোই রয়েছে। ব্যাংকগুলোরও এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না।

সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রতি মাসে ২ বিলিয়নের ওপর রেমিটেন্স আসছে। মাঝে এক মাসে তিন বিলিয়নের ওপরও রেমিটেন্স এসেছে। বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও ডলারের দর কমার একই কার‌ণ তুলে ধরেন।

তার মতে, রেমিটেন্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বাড়ায় এবং বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে ঋণ আসার কারণে ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নতি হয়েছে। যে কারণে ডলারের দর আগের চেয়ে কমেছে।

জুনের শেষে আইএমএফ থেকে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, এডিবি থেকে দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) থেকে দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার ও এআইআইবি থেকে দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় হয়েছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, “আমদানিতে খরচ কমলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই ভালো। রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা হয়ত কিছুটা কম দর পাবেন। তবে তাতে বড় কোনো হেরফের হবে না।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দুই ঈদে অনেক ভালো রেমিটেন্সের প্রবাহের বিপরীতে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। যোগান ও চাহিদার এ সূত্রেই দাম কমেছে ডলারের।

আরও কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারাও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার তথ্য দেন। একজন ট্রেজারি প্রধান বলেন, “বিনিয়োগ যে হচ্ছে না তার প্রধান সূচক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। সরকার পতনের পর থেকেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে।” এমন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসায় ভাটা পড়াই মূলত ডলার দর কমে যাওয়ার কারণ। নতুন ব্যবসা না থাকার কারণে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমেছে।

টানা ৭ মাস ধরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে। মে মাসে এ খাতে ঋণ ছাড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে যা ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে আরেকটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডলারের দর ক্রমাগত কমতে থাকলে সেটিও অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এতে প্রবাসী ও রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তখন ডলারে আয় আসা কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বেক্সিমকো, এস আলমের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এসব শিল্প গ্রুপের কারখানাগুলোর অবদান আছে। অগাস্টের পর থেকে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানেরও মূলধন যন্ত্রপাতি আনা বন্ধ হয়েছে।

মাদারীপুর গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আব্দুস সোবহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকের ঋণের জন্য ১৫-১৬ শতাংশের মত সুদ দেওয়া লাগে। যে কারণে লোকসানের ভয়ে অনেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এর প্রভাবে ডলার বাজারে আর আগের মত চাঙ্গা ভাব নেই।

সূত্র: বিডি নিউজ ২৪

সর্বশেষ: