সংগৃহীত
ঘরে-বাইরে এখন সমানতালে কাজ করছেন নারীরা। কায়িক শ্রম, নিরাপত্তা, পারিপার্শ্বিকতার দিক বিবেচনা করে কিছু কাজ আছে, যেগুলো সাধারণত পুরুষেরাই করে থাকেন। প্রথা ভেঙে সেই কাজেও নিজেদের প্রমাণ করছেন আজকের নারীরা।
সড়কে দুর্বার গতিতে নারীদের স্কুটি কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতে দেখে অভ্যস্ত মানুষ। কিন্তু রাজপথে যাত্রীবাহী লেগুনার চালকের সিটে কোনো নারীকে দেখলে চমকে ওঠারই কথা। চমকে দেওয়া এমনই একজন নারী মুক্তি রানি। পেশায় লেগুনাচালক।
‘নারীর জন্য ভিন্ন এ রকম পেশায় নিজেকে কেন জড়িয়েছেন?’ জানতে চেয়েছিলাম মুক্তি রানীর কাছে। উত্তরে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মুক্তি রাণী, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। পোশাকশ্রমিক মানেই তো মানুষের খারাপ ব্যবহার। মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হতো। তাই একদিন সিদ্ধান্ত নিই এই মন খারাপ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার।
আমার বাবা অটো চালাতেন, দুই ভাইও ড্রাইভার। ভাবলাম তাহলে আমিও চলে আসি এই পেশায়। আমার ভাই দুই বছর ধরে ধৈর্য সহকারে আমাকে গাড়ি চালানো শিখিয়েছেন। মূলত স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্যই আমার এই স্বাধীন পেশায় আসা।
কোনো কোনো যাত্রী নারী-চালককে দেখে খানিকটা থমকে যান। আবার কেউ সরাসরি জানতে চান তিনিই চালক কিনা। দক্ষ হাতে শুধু গাড়ির স্টিয়ারিংই সামলান না, যাত্রী খুঁজে আনা, ভাড়া তোলা-সব কাজ একা হাতে করেন মুক্তি রানীই। প্রায় দুই বছর ধরে সাভারের আশুলিয়া এলাকায় লেগুনা চালাচ্ছেন তিনি। এর আগে গাড়ি চালানো ও লাইসেন্স পেতে লেগেছে দুই বছর। নারী-ড্রাইভার দেখে সন্দেহে থমকে যান অনেক যাত্রী। কিন্তু যাঁরা নিয়মিত এই পথে যাতায়াত করেন, তাঁরা একনিষ্ঠ ভক্ত মুক্তি রানীর। দক্ষ হাতে যাত্রীদের তিনি পৌঁছে দেন গন্তব্যে। প্রতিদিন গড়ে তাঁর আয় হয় ৫০০ টাকা।
লেগুনার চালকের আসনে নারী-দৃশ্যটি নতুন। রিকশাচালক ও মোটরসাইকেলচালকদের অনেকেই বাজে কথা শোনান। সেই সঙ্গে আছে বাজে অঙ্গভঙ্গি দেখানো। অনেকেই মুক্তি রানীকে এমনভাবে দেখেন, যেন এই নারী ভিনগ্রহের কেউ। তবে গত দুবছরে এগুলো গা-সওয়া হয়ে গেছে তাঁর।
নারী হিসেবে কখনো কি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন? উত্তরে মুক্তি রানী বলেন, ‘মাঝে মাঝে এমনও হয়, লেগুনার ১০ থেকে ১২ জন যাত্রীর সবাই পুরুষ, চালকের আসনে আমি একা নারী। তখন দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় নিজেকে আর লেগুনা নিয়ে। আবার দীর্ঘসময় গাড়ি চালাতে গিয়ে শৌচাগারের সমস্যায় বেগ পেতে হয়। নারী বলেই যেখানে-সেখানে যেতে পারি না। কাছাকাছি তেল ও পেট্রলপাম্প ভালো না থাকলে অসুবিধা হয় বেশি। অনেক সময় বাধ্য হয়ে গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।’
মুক্তি রানীর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায়। স্বামী তপন চন্দ্র বিশ্বাস আশুলিয়ায় একটি পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেন। আশুলিয়ার উত্তর গাজীরচট এলাকায় এক কক্ষের বাসায় থাকেন এই দম্পতি। লেগুনা চালাতে বাবা, স্বামী ও ভাইদের কাছ থেকে সমর্থন পেলেও মা সন্ধ্যা রানী দাশ মেয়ের লেগুনা চালানো পছন্দ করেন না। মেয়ে রাস্তাঘাটে কখন কোন বিপদে পড়েন-তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন মা। মায়ের মনে সারাক্ষণ থাকে মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তা। আর মেয়ে লেগুনা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে ভাবেন শুধু তাঁর নাড়িছেঁড়া ধনদের কথা। মুক্তি রানীর এক ছেলে পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে। আর সাত বছর বয়সী মেয়ে পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে। তারা আছে তাদের দাদি এবং ফুপুর কাছে, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। ছেলেমেয়েরা দূরে থাকে। মায়ের বুকটা খালি খালি লাগে। ছেলেমেয়েদের কথা বলার সময় কণ্ঠটা ভারী হয়ে ওঠে মুক্তি রানীর। অশ্রুসজল হয় দুচোখ।
গাড়ি চালানোর সময় ফোন দেয় তারা? দিনে কতবার কথা হয় প্রিয়মুখ সন্তানদের সঙ্গে? মুক্তি বলেন, ‘গাড়ি চালানোর সময়টা সম্পর্কে ওরা জানে। সেই সময় ফোন দেয় না। কাজের অবসরে আমিই ফোন দিই। আর রাতে বাড়ি ফিরে ননদের ফোনে ভিডিও কলে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের দেখি। ফোনের মধ্যে দেখে চোখ জুড়াই।’
ঈদের আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু লম্বা এই ছুটিতে বাড়ি যাওয়া হবে না মুক্তি রানীর। ঋণের টাকায় কেনা লেগুনাটি বিক্রি করে দিয়েছেন ঋণ পরিশোধের জন্য। এখন ভাড়ায় লেগুনা চালাচ্ছেন। নারী-ড্রাইভার বলে মালিকেরা লেগুনা ভাড়া দিতে চায় না অনেক সময়। ঈদের এই সময়টাতে সবাই যখন বাড়ি যাবেন তখন তাঁর আর যাওয়া হবে না। তখন লেগুনা ভাড়া পাওয়া সহজ হবে, তাই আর্থিক ক্ষতি পোষাতে ঢাকায়ই থাকবেন মুক্তি রানী।
‘ঈদের ছুটি মানেই তো বাড়ি যাওয়া। সন্তানদের জন্য কেনাকাটা করে তাদের কাছে যাওয়া। সারাবছর কত স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এই সময়টাতে এসে কুলিয়ে উঠতে পারি না অভাব-অনটনের জন্য। সবার বাবা-মা যায়, আমার ছেলেমেয়েরাও তো পথপানে চেয়ে থাকে...।’ ওড়নার আঁচলে চোখ মোছেন মা মুক্তি রানী।
এই মা স্বপ্ন দেখেন, একদিন অভাবের ঘেরাটোপ কাটিয়ে তিনিও বাড়ি যাবেন। সন্তানদের বুকে আগলে ঈদ করবেন। মুক্তি রানীর মতো বাড়ি ফেরার এই আকুলতা সবার। তাই এই ঈদে স্বপ্নগুলো বাড়ি ফিরে আসুক, সবার ঈদ আনন্দের হোক।
সূত্র: প্রথম আলো