মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ২২ আশ্বিন ১৪৩২

ক্লাসরুমের হিরোরা দিন পার করেন অভাবে

ক্লাসরুমের হিরোরা দিন পার করেন অভাবে

সংগৃহীত

জাতির কাছে তারা আলোর দিশারি। সমাজে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। তবুও জীবনের হিসাবের খাতায় তারা রয়ে যান ঘাটতির পাতায়। চক হাতে ক্লাসে জ্ঞান ছড়িয়ে দেন কিন্তু বাইরে প্রতিনিয়ত লড়েন টানাপোড়েনের জীবনের সঙ্গে। মাসের শেষ হওয়ার আগেই টান পড়ে সংসারের বাজেটে। কারণ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা– সবকিছুর বোঝা বইতে হয় সীমিত আয়ে। মর্যাদার আড়ালে চলা এই নীরব সংগ্রাম দেশের অধিকাংশ শিক্ষকের জীবনের চরম বাস্তবতা। ক্লাসরুমে তারা নায়ক কিন্তু জীবনের মঞ্চে একেকজন যন্ত্রণার যাত্রী।

ঢাকার উপকণ্ঠের একটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুলের সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ক্লাসে পাঠদান শুরু করেন। গরম, ধুলো কিংবা যানজট—সবকিছুর ভিড়েও তিনি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান নিষ্ঠা নিয়ে। তবে মাস শেষে হাতে পান মাত্র ১৬ হাজার টাকা বেতন। এ অর্থে পরিবারের তিনজনের খরচ মেটাতে গিয়ে তাকে প্রায়ই ধার করতে হয়।

হাবিবুর রহমান বলেন, আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্মান দেয়, ক্লাসে মন দিয়ে শোনে—এই সম্মানই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। কিন্তু ক্লাস শেষে যখন বাজারে যাই, তখন সেই সম্মান দিয়ে তো কিছু কেনা যায় না। দোকানদার তো বলে না, ‘স্যার, আপনি শিক্ষক, তাই কম দামে চাল-ডাল নিন।’ মাসের শেষভাগে যখন বেতন শেষ হয়ে যায়, তখন সংসারের খরচ মেলাতে হিমশিম খেতে হয়। কখনো ধার করি, কখনো বন্ধুদের সাহায্য নিই। ছাত্রদের সামনে আমি গর্বিত একজন শিক্ষক কিন্তু ঘরে ফিরলে আমি একজন সাধারণ মানুষ, যে টিকে থাকার লড়াইটা প্রতিদিন নতুন করে শুরু করে।

এই শিক্ষকের মতে, তার মতো দেশের শহর ও গ্রামের স্কুলের আরও হাজারো শিক্ষক একই বাস্তবতার মুখোমুখি। যারা শিক্ষার আলো ছড়ালেও নিজেদের ঘরে জ্বলছে কুপির মৃদু আলো।

বিশ্লেষণ বলছে, সরকারি-বেসরকারি দুই খাতেই শিক্ষকদের জীবনে স্থিতি নেই। যদিও সরকারি শিক্ষকরা কিছুটা স্থায়ী সুবিধা পান। কিন্তু বাড়তি খরচ ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে তাদের জীবনও কঠিন হয়ে উঠছে। তবে বেশি বিপাকে আছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। একই যোগ্যতা ও কর্মঘণ্টা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন ভেদে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তারা (বেসরকারি শিক্ষকরা) সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় অনেক কম সুবিধা পান, যা জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যও যথেষ্ট নয়।

শিক্ষকদের আক্ষেপ, এই বৈষম্য শুধু আর্থিক অনিশ্চয়তাই বাড়ায় না, বরং শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও মনোবলকেও গভীরভাবে আঘাত করে। এ অবস্থায় সংসারের খরচ মেটাতে কেউ টিউশন, কেউ কোচিং, কেউ আবার অনলাইন ক্লাসে সময় দেন সামান্য বাড়তি আয়ের আশায়।

সাভারের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক মুবিনুল ইসলাম বলেন, আমার ছাত্ররা দেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কেউ কেউ সরকারি চাকরিতেও ঢুকেছে। কিন্তু আমি আজও ভাড়া বাড়ির শিক্ষক। বাংলাদেশে শিক্ষকতায় সম্মান আছে, স্থিতি নেই। শিক্ষকরা সমাজে মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসেন কিন্তু তাদের জীবনের মান সেই মর্যাদার সঙ্গে যায় না।

তিনি আরও বলেন, একজন শিক্ষক যতই চেষ্টা করুন, বেতন বা সুবিধার কাঠামো তাকে জীবনযুদ্ধ থেকে মুক্তি দেয় না। স্কুলে দাঁড়িয়ে যে মুখে তিনি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখান, বাড়ি ফিরতেই সেই মুখে নেমে আসে জীবনের ক্লান্তি।

শাহনাজ পারভীন নামের আরেক শিক্ষক নিজের কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, আমরা প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের আলোকিত জীবনের স্বপ্ন দেখাই অথচ নিজেদের জীবন আঁধারে ডুবে থাকে। ক্লাসে গিয়ে পড়াই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কিন্তু বাজারে গিয়ে টাকার হিসাব করতে গিয়ে লজ্জায় চোখ নামাতে হয়। বেতনের টানাপোড়েনের কারণে সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারি না, চিকিৎসার খরচ জোগাতেও হিমশিম খেতে হয়। শিক্ষকতার মর্যাদা আছে ঠিকই কিন্তু আমাদের সংসারে তার কোনো প্রতিফলন নেই।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী। ঢাকা পোস্টকে শিক্ষকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের হাজারো এমপিওভুক্ত শিক্ষক অত্যন্ত স্বল্প বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা গড়ে ১৬ হাজার টাকার আশপাশে বেতন পান, আবার অনেক শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা কিংবা মাদ্রাসা পর্যায়ে মাত্র ৯ হাজার ৩০০ টাকা বেতনে চাকরি করছেন। এই সামান্য আয়ে শিক্ষকদের পক্ষে পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজার দরের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসের মাঝামাঝি আসতেই অনেক শিক্ষক আর্থিক টানাপোড়েনে পড়েন।

তিনি অভিযোগ করেন, সামান্য বিলম্বে বেতন পেলে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সরকারকে বারবার বাড়ি ভাড়া ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানানো হলেও এখনো তা পূরণ হয়নি। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা শতকরা হারে দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত মিললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এই শিক্ষক নেতা বলেন, আমরা সরকারের প্রতি সম্মান রেখেই অনেক দাবি থেকে সরে এসেছি। কেবল বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য দাবি উত্থাপন করেছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় ৫, ১০, ১৫ এবং ২০ শতাংশ— চারটি স্লটে প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা শিক্ষকদের প্রত্যাশার সঙ্গে যায় না। আমরা চাই স্পষ্টভাবে ২০ শতাংশ ভাতা বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন।

আগামী ১২ অক্টোবর ঢাকায় সর্ববৃহৎ কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়ে দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, আমরা কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার যদি ১০ অক্টোবরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি না করে, তাহলে আমরা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করব।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে আগে শিক্ষকদের জীবনমান নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়ত সম্মান ও বাস্তবতার এই ফাঁক দিন দিন আরও বিস্তৃত হবে।

শিক্ষাবিদ ও ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই. কে. সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, শিক্ষক সমাজ আমাদের জাতির মেরুদণ্ড। বিশেষ করে দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সীমিত সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নিয়ে শিক্ষা সেবায় নিয়োজিত আছেন। তাদের মাসিক আয় মাত্র ১৬ হাজার টাকার মতো, যা দিয়ে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও কঠিন। তবুও তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন অগাধ ত্যাগ ও আত্মনিবেদন দিয়ে, এটা সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক।

অধ্যাপক খোন্দকার বলেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশা রাখে– তারা যেন ভালো মানুষ তৈরি করেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখান, সমাজকে আলোকিত করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো– যারা আলোর প্রদীপ জ্বালান, তাদের নিজের জীবনেই অন্ধকার নেমে আসে। তাই সময় এসেছে রাষ্ট্রের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার। শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান, ন্যায্য বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক কর্তব্য নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য বিনিয়োগ।

তার মতে, শিক্ষকরা যদি নিশ্চিন্ত জীবনের নিরাপত্তা পান, তাহলে তারাই পারবেন আগামী প্রজন্মকে জ্ঞান, সততা ও দেশপ্রেমে আলোকিত করে তুলতে। তাই শিক্ষকদের জীবনের মানোন্নয়নকে জাতীয় অগ্রাধিকারের স্তরে নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র: ঢাকা পোষ্ট

সর্বশেষ:

শিরোনাম: