সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’ তিনি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল রোববার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। সভার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। হতাহতদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে কাঁদতেও দেখা যায়। খবর বাসসের।
গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এতদিন তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিল এবং আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। তারা কি এখন চুপচাপ বসে থাকবে? না, তারা খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’
সফল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এই সুযোগ আসেনি। তবে সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে, বাংলাদেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। রাষ্ট্র আর থাকবে না। কাজেই এটা শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটা করতে হবে।’
তরুণরা কোন জাদুমন্ত্রে বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটিত করেছে, তা দেখতে সারা দুনিয়ার মানুষ এ দেশে আসবে– এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসবে, তোমাদের কাছ থেকে শিখতে আসবে। তোমাদের কাছে জানতে চাইবে, কোন মন্ত্র দিয়ে এই বিপ্লব করেছো। এই মন্ত্র তারা শিখতে চাইবে। তোমাদের মন্ত্র কী, সেটা হয়তো তোমরা বুঝতে পারছো না। এটা একটা বড় মন্ত্র। এই মন্ত্র ধরে রাখো। মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদেরকে দেখতে না হয়।’ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণরা দেশের হাল ধরেছেন উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তারা অনন্য এক বাংলাদেশ তৈরি করে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকার পরামর্শ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ ও সঠিক। তোমরা নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকো। কেউ যদি স্বপ্ন পূরণের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়, সেটা গ্রহণ করো না। তিনি বলেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে যদি আমরা দূরে সরে যাই, তাহলে আমাদের সতর্ক করে দেবে। আমাদের কারোর কোনো ইচ্ছা নেই এই স্বপ্নের বাইরে যাওয়ার। আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ হলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। একযোগে এ কাজ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেখছি আর ভাবছি কী একটা স্বপ্ন আমাদের সবার সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছো। যারা শহীদ হয়েছে, তাদের স্মরণ করি। যারা শহীদ হয়েছে, তারা চলে গেছে। তোমাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, তোমরাও শহীদ হয়ে যেতে পারতে। শহীদরা আজ আমাদের সঙ্গে বসতে পারত, সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি।
আহতদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘যখন হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য যাই, তাদের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এ রকমভাবে কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওই দিকে মাথা।’ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বলল, ফুটফুটে একটা ছেলে, স্যার আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন, আমার পা কেটে ফেলেছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, স্যার ক্রিকেট খেলব কী করে? ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘আহতদের যতবার দেখি, ততবার মনে প্রশ্ন জাগে– কী বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছি যে এতগুলো তাজা প্রাণ, তাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের মূল্যের স্বপ্ন পূরণ করা।’
নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাওয়ার কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘হাসপাতালে গেলাম আবার সেই দৃশ্য কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্স-রেতে দেখা যাচ্ছে ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে কী দেখাচ্ছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম। এগুলো কী? এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে। সে বেঁচে আছে রাবার বুলেট, যতবার দেখি যতবার শুনি আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে, সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করব। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে; কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইল, আমরা স্বপ্ন পূরণ করব। হাসপাতালের দৃশ্য এবং আন্দোলনের প্রতিদিনের ঘটনা মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে এর পেছনে কী ছিল।
সভায় উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
সূত্র: সমকাল