রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

মোঃ মনসুর আলী: আইন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রদায়িত্বে আপসহীন এক নেতৃত্ব

মোঃ মনসুর আলী: আইন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রদায়িত্বে আপসহীন এক নেতৃত্ব

সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে মোঃ মনসুর আলী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান আইনজীবী, দক্ষ সংগঠক এবং সংকটকালে দায়িত্ব নিতে জানা এক রাষ্ট্রনায়ক।

মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন প্রতিটি পর্যায়েই তিনি দায়িত্বশীলতা, শৃঙ্খলা ও বাস্তববাদী নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন।প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষামোঃ মনসুর আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার রতনকান্দি ইউনিয়নের কুড়িপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা হরফ আলী সরকার ছিলেন একজন সৎ ও সম্মানিত ব্যক্তি। শৈশব থেকেই মনসুর আলীর মধ্যে শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব ও অধ্যবসায়ের পরিচয় পাওয়া যায়।শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৃতী। কাজিপুর গান্ধাইল হাই স্কুল ও সিরাজগঞ্জ বি.এল. হাই স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ এবং আইন বিষয়ে এল.এল.বি ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। উচ্চতর শিক্ষায় তাঁর এই সাফল্য পরবর্তী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে।আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি১৯৫১ সালে পাবনা জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন মোঃ মনসুর আলী। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় আইনজীবী হিসেবে পরিচিত হন। পাবনা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে তিনি আইনি অঙ্গনে নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন আপসহীন।রাজনৈতিক উত্থানশিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরি করেন।পরবর্তী সময়ে তিনি আইন, সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তিনি প্রশাসনিক দক্ষতা ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের পরিচয় দেন। সামরিক শাসনামলে কারাবরণ করলেও তিনি রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোঃ মনসুর আলী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রবাসে গিয়ে সংগঠিত সরকারের অংশ হন। মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সীমিত সম্পদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখতে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম।স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনাস্বাধীনতার পর তিনি যোগাযোগ, স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত মজবুত করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, দলীয় শৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কার্যকর রাখার উপর গুরুত্ব দেন।নির্মম হত্যাকাণ্ড১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় মোঃ মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত, যা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে নির্মমভাবে স্তব্ধ করে দেয়।স্মরণ ও উত্তরাধিকারমোঃ মনসুর আলীর স্মরণে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়েছে—যা তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বহন করে। তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল রাজনীতি, প্রশাসনিক দক্ষতা ও ব্যক্তিগত সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।মোঃ মনসুর আলী ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি ক্ষমতার চেয়ে কর্তব্যকে বড় করে দেখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি নীরব দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে আজও স্মরণীয়।

সর্বশেষ:

শিরোনাম: