ভারতবর্ষের অতীতকালে সম্পর্ক কতটা সহজ ছিল, এই নিয়ে অনেক প্রামাণ্য রয়েছে। যার ভিত্তি হল বিভিন্ন পুরাণ কাহিনি, ঋগবেদ এবং মহাভারত। যেখানে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় এমন কিছু সম্পর্কের কাহিনি সামনে এসেছে যেখান থেকে একটা ছবি স্পষ্ট হয় যে নারী-পুরুষ এই সম্পর্কের বাইরে কোনো সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা সেভাবে ছিল না। এই সময়কালকে কেউ বৈদিক যুগের বলে দাবি করেন, কেউ বলেন তারও আগে এবং মহাভারতের সমসাময়িক।
এই সব পুরাণ কাহিনিতে বিবৃত করা হয়েছে যে, এক নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারতো। এমনকী পুরুষরা একইরকমভাবে একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতো। বিবাহের বিষয়টিও সেভাবে মূল্য পেত না এখানে। বলতে গেলে ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’-এর কনসেপ্ট। এমনই কিছু কাহিনি এখানে তুলে ধরা হয়েছে-
কৌতবিক- এটা একটা যৌনমিলনের ক্রীড়া। যা কৌতবিক নামে পরিচিত। ইংরাজিতে একে ইনসেস্ট বলা হয়। গোদা বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় নিজস্ব পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের ভেদাভেদ ভুলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যৌন সম্পর্কে জড়ান। পুরাণ গ্রন্থে এই ধরনের যৌন সম্পর্কের উল্লেখ মেলে। এমনই এক পুরাণ কাহিনি হরিবংশ-এ উল্লেখ আছে যে বশিষ্ঠ মুনির মেয়ে শতরূপা তার পিতাকেই নিজের স্বামী রূপে কল্পনা করতেন এবং সেই কারণে তিনি পিতা বশিষ্ঠের সঙ্গেও নিয়মিত যৌন মিলনে রত হতেন। একই গ্রন্থে এমনও উল্লেখ রয়েছে যে, রাজা দক্ষ নিজের পিতার হাতে তার কন্যাকে সমর্পণ করেছিলেন। এই সম্পর্ক থেকেই জন্ম হয় ব্রক্ষ্মা ও নারদের। হরিবংশে এও উল্লেখ রয়েছে যে, দেবরাজ ইন্দ্র খোদ নাতবউ ভাপুসথমা-র সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন।
মহাভারতের আদি পর্বে উল্লেখ রয়েছে, একটা সময় ছিল যখন নারী ও পুরুষের সত্তার মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক স্থান পেত না। কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের কাছে যৌন মিলনের ইচ্ছে প্রকাশ করতেন, তাহলে তা বিধর্মী বলে অ্যাখ্যায়িত হত না। বরং নারী মর্যাদা রক্ষার্থে সেই পুরুষকে অনিচ্ছাহেতু যৌন মিলন করতে হতো। এমনই এক সম্পর্কের হাত ধরে উলুপি অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গম করেছিলেন। অর্জুন তখন বনবাসে। সে সময় নাগ রাজকন্যা উলুপি অর্জুনের প্রেমে পড়েন এবং তাকে অপহরণ করেন। জোর করে নারীর যৌন ইচ্ছের মর্যাদার প্রসঙ্গ টেনে অর্জুনের সঙ্গে সম্পর্কে রত হয়েছিলেন। এই সম্পর্কে অর্জুন ও উলুপির-র পুত্রসন্তানও জন্মলাভ করেছিল। তার নাম ছিল ইরাভান।
নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা বলে অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গমের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন ঊর্বশী। এদিকে, সম্পর্কের দিক থেকে উর্বশী ছিলেন অর্জুনের শিক্ষাগুরু। অর্জুন তখন দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে গিয়েছেন ইন্দ্রদেবের কাছ থেকে অস্ত্র প্রাপ্ত করতে। সে সময় দেবরাজ ইন্দ্রের পরামর্শে উর্বশীর কাছে নাচ ও গানের প্রশিক্ষণ নেন অর্জুন। এই সময়ে অর্জুনের প্রেমে পড়েন উর্বশী। তিনি সরাসরি অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করেন এবং যৌন মিলনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু অর্জুন জানিয়ে দেন তিনি ঊর্বশী-কে মা ও শিক্ষাগুরুর দৃষ্টিতে দেখেন। এতে ক্ষিপ্ত ঊর্বর্শী অর্জুনকে এক বছরের জন্য পুরুষত্বহীনতা এবং একজন ক্লীবের জীবন-যাপনের অভিশাপ দেন। ধর্মীয় আরও গ্রন্থে এও উল্লেখ রয়েছে যে ঋষি অগ্যস্ত খোদ নিজের কন্যা রাজা বিদর্ভের জিম্মায় ছোট থেকে রেখে দিয়েছিলেন। সেই কন্যা বিবাহযোগ্যা হলে অগ্যস্ত তাকে স্ত্রী রূপে বরণ করেন।
দশম মণ্ডল, ঋকবেদ- এখানে যমরাজ এবং তার বোন যমুনা-র কিছু যৌন উস্কানিমূলক কথা-বার্তার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে যমুনা তার ভাই যমের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। কিন্তু যম এতে আপত্তি জানাতেই যামুনা তাকে স্মরণ করান যে, ভাই থাকতেও তার বোন যৌনতার তৃপ্তি পাবে না, এটা বিধর্মী ভাবনা! এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে অতিতকালে ভাই-বোনের মধ্যেও যৌন সম্পর্ক স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হতো।
মহাভারতের আদিপর্বে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে এই সময়ে যেকোনো নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে অস্বাভাবিক বলে দেখাই হত না। বরং যদি কোনো নারীর সঙ্গে যে কোনো পুরুষের মিলন স্বাভাবিক বলেই মনে করা হত। এমনকী এক নারীর একাধিক পুরুষের সঙ্গে এবং এক পুরুষের একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে মর্যাদা সহকারেই বিবেচনা করা হতো।
নারী তার যৌন সম্পর্কে তৃপ্ত করতে চাইলে পুরুষকে যে রাজি হতে, তার আর এক উদাহরণ ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ। দাদা হিড়িম্বি- ভীমের হাতে নিহত হয়। এই ঘটনার আগেই হিড়িম্বা প্রেমে পড়েছিল। ভাইয়ের মৃত্যু হতেই হিড়িম্বা নিজেই ভীমকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এমনকী তার সন্তানের মা হতে চেয়েছিল। কুন্তির নির্দেশে ভীমকে নারীর এই ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে হয়েছিল। যদিও, ভীমের দেওয়া শর্ত মোতাবেক সন্তানের জন্ম দিতেই হিড়িম্বা একাকি থাকতে শুরু করে এবং তাদের সন্তান ঘটোৎকচকে একাকী মানুষ করতে থাকে।
আলোকিত সিরাজগঞ্জ