মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা

‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখী উদ্যোগ নেন।

সবার আগে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি। তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করেন, পাশাপাশি গুরুত্বারোপ করেন কর্মমুখী শিক্ষার ওপর। প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন গবেষণাকর্ম বাড়ানোর তাগিদ দেন।

বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন- শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর নিজেকে, তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, শিল্পকলা, দেশ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মানুষের জীবনসংগ্রাম, মানবসভ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়।

শিক্ষা একজন মানুষকে সচেতন, সংবেদনশীল, নৈতিক, সৃষ্টিশীল, আত্মপ্রত্যয়ী ও মানবিক গুণে গুণান্বিত করে তোলে। তবে এজন্য থাকা চাই সুশিক্ষা বা সত্যিকার শিক্ষা। কেননা সুশিক্ষার মূলে থাকে দেশ, মানুষ ও মানবকল্যাণ।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, মানবকল্যাণকামী, অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক ধাঁচের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতিবিরোধী বাংলার ছাত্রসমাজের শিক্ষা আন্দোলন জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’ অর্থাৎ মানবিক গুণে গুণান্বিত দক্ষ জনসম্পদ। আর এটি করতে হলে প্রয়োজন সুশিক্ষা।

গবেষণানির্ভর এ সুশিক্ষা বাস্তবায়ন করতে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়।

’৭২-এর সংবিধানে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,

(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তার শিক্ষাভাবনা সম্বন্ধে আমরা সম্যক ধারণা পাই।

ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ‘ক্যাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সব শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে।

দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতেও পদক্ষেপ নেন বঙ্গবন্ধু। এ ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেছেন বঙ্গামাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নারী শিক্ষা সম্বন্ধে বলেন, ‘শতকরা ২০ জন শিক্ষিতের দেশে নারীর সংখ্যা আরও নগণ্য। ... ক-খ শিখলেই শিক্ষিত হয় না, সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত হইতে হইবে।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রুদের গভীর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যসহ অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে থমকে যায় বাংলার মানুষের স্বপ্ন দেখা।

পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন এবং স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ মূলত বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনারই ফসল।

দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষানীতি বলতে কিছু ছিল না। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতাত্তোর বহুবার ব্যর্থ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১০ সালে সর্বমহলের মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা, যুগের চাহিদা ও দেশের প্রয়োজন উপযোগী একটি সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, যা এখন বাস্তবায়নাধীন।

প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত হবে এ দেশের তরুণ-যুবারা। তারাই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে তুলবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। মুজিব শতবর্ষে এ হোক ব্রত।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

আলোকিত সিরাজগঞ্জ