বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদদের রক্তের পবিত্রতা রক্ষায় স্বপন মির্জার পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার

শহীদদের রক্তের পবিত্রতা রক্ষায় স্বপন মির্জার পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার

একটি বিশেষ দিনেই কেবল ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘শহীদ মিনার’ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়ে থাকে। এরপর সারা বছর পবিত্র স্থানটি থাকে অবহেলায় অরক্ষিত এবং অপরিচ্ছন্ন।

দেশের অধিকাংশ শহীদ মিনারের এমন অবস্থা থাকলেও মহান শহীদদের রক্তের পবিত্রতা রক্ষায় ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের জন্ম ভুমি এলাকা সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার গোপিনাথপুরে নির্মিত শহীদ মিনারটি একে বারেই ব্যতিক্রম।

একটি গণমাধ্যমের সাধারন কর্মী মানবতাবাদী ভুমিহীন স্বপন মির্জার এই শহীদ মিনারটি দৃষ্টিনন্দন পরিচ্ছন্ন। এলাকার সকলকে ভাল কাজে উৎসাহিত ও মানবিক কল্যানে কাজ করা স্বপন মির্জা সহ গ্রামবাসী এর পবিত্রতা রক্ষা করেন পরম ভালবাসায়। তাই শহীদ মিনারটি দেখলে যে কেউ অবাক হবেন।

এদিকে এ শহীদ মিনার দেখভালের জন্য রয়েছে আলাদা রক্ষনা-বেক্ষন কমিটি। তাদের তত্বাবধানে শহীদ মিনারটি প্রতিদিন ২ বার ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে সপ্তাহে অন্তত ৩ বার পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। ফুলের সমারহ ঘেরা এই শহীদ মিনারটি এখন পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অন্যদের জন্য হতে পারে অনুকরণীয়।

স্বপন মির্জা পেশায় একজন সাধারন সংবাদ কর্মী। একুশে টেলিভিশনের সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে টেলিভিশনে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে কাজ করছেন। জেলার এনায়েতপুর থানার গোপিনাথপুর গ্রামে ছোট বেলা থেকেই নানা অভাব কষ্টে বড় হওয়া স্বপন মির্জা (৩৮) ছোট বেলা থেকেই মানবতার কল্যানে ভাল কাজ নিয়ে নিবেদিত রয়েছেন। ২০০২ সালে সাংবাদিকতা শুরুর পর টেলিভিশন ও পত্রিকায় তার প্রকাশিত সংবাদ আলোচিত হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এজন্য সেরা প্রতিবেদক হিসেবে জাতীয় ও স্থানীয় ভাবে পুরস্কার পেয়েছেন।

তবে এই মানুষটি এনায়েতপুর থানা জুড়ে নানা ভাল কাজের উদ্যোক্তা হলেও নিজের নেই ঘটি-বাটি। সাংবাদিকতার মহান আদর্শকে বুকে লালন করা স্বপন মির্জা বিবাহিত জীবনে তিনি ৬ বছরের একটি ছেলে সন্তানের জনক। থাকার জন্য নিজের নেই কোন ঘর-বাড়ি। থাকেন এক বাড়ির আশ্রিতা হয়ে দীর্ঘ দিন ধরে। তার বাবা দরিদ্র একজন কৃষক। ছোট ভাই সুজন মির্জা টিউশনী করে মাটার্স পাশ করেও বেকার। কোন রকমে চলে সংসার। সাংবাদিকতার চাকুরীতে যে সম্মানী পান তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চালানোর পাশাপাশি মানবিক কল্যানে রাখেন ভুমিকা।

এছাড়া অতোটা আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও এলাকার কবরস্থান, ঈদগা মাঠ নির্মান সহ ধর্মীয় নানা কাজে উদ্যোক্তা হয়ে পাশে থাকেন। কোন-কোন সময় রাস্তা নির্মানে নিজেই মাথায় নেন টুকড়ি বোঝাই মাটি। পাশাপাশি দুর্যোগে ত্রান সহায়তা বিতরনেও এলাকার ভিখারী, সাধারন মানুষদের সম্পৃক্ত করে শীত বস্ত্র বিতরন, বন্যায় ত্রান সামগ্রী বিতরন, ঈদে দুস্থদের পোশাক ও খাদ্য সামগ্রী বিতরনে ভুমিকা রাখছেন। এলাকায় অসহায় ভিখারী ও শ্রমজীবিদের সামাজিক ও গুরুত্বপুর্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করেও তিনি সম্মানিত করছেন।

সমাজ কর্মী স্বপন মির্জার অন্যতম উদ্যোগ গোপিনাথপুর গ্রামে শহীদ মিনার নির্মান। ২১ ফেব্রুয়ারী এলেই বাঁশ ও কলাগাছের ক্ষনিকের শহীদ মিনারই শহীদদের স্মরণে ভরসা ছিল এলাকার মানুষের। ২০১৩ সালে এখানে ফুল দিতে গিয়ে সবাই দাবী করে বললেন, একটি শহীদ মিনার নির্মানের জন্য। স্বামর্থ না থাকলেও ভাল কাজে হা বলতে পারা স্বপন মির্জা স্বীকার করেন। পরে ২০১৪ সালের জুনের দিকে থাকার ঘর করার জন্য গচ্ছিত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন এ কাজ। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে একুশে ফোরাম সিরাজগঞ্জের সভাপতি ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান তালুকদার তার হাতে তুলে দেন ৩০ হাজার টাকা, ঢাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না ৫ হাজার, এলাকার ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন দেন ১৫ হাজার টাকা।

আরো কিছু টাকা যোগ করে তিনি প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মান করেন স্বপ্নের শহীদ মিনার। যা এলাকার কৃতি সন্তান ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পুরোধা ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের উদ্ধোধনের কথা ছিল। কিন্তু ৪ অক্টোবর হঠাৎ তার মৃত্যু হলে ঐ বছরের ১৭ ডিসেম্বর ভাষা মতিনের স্ত্রী গুলবদন নেছা মনিকা সহ স্থানীয় ২ জন সাংসদ এ শহীদ মিনারটি উদ্ধোধন করেন। এসএস পাইপের মিনার ও মুল্যবান টাইলস্ দিয়ে বেদী মোড়ানো কাঠামোর শহীদ মিনারটি দেশের মধ্যে আসলেই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। ১২ ফুট প্রস্থ ও ১৪ ফুট লম্বা এ শহীদ মিনারটি ছোট হলেও এর অনন্য স্থাপত্য শৈলী যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।

এছাড়া গত ২ বছর আগে আরো সাড়ে ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে শহীদ মিনারটির নিরাপত্তা প্রাচীর ও পাশে মাটি ভরাট করে গড়া হয়েছে একটি বাগান। এজন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ২ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। রাতেও আলোকিত রাখতে শহীদ মিনার ও তার আশপাশ ঘিরে আম, বট, মেহগনি, কড়ই গাছে লাগানো হয়েছে রং বেরংগের ৮টি ফানুষ বাতি ও আরো ৪টি লাইট। তাতে বিভিন্ন ধরণের আলো সাড়ারাত আলোকিত রাখে পুরো শহীদ মিনার তথা আশপাশ। নানা আলোর এমন দৃশ্য সারা বছর দেশের আর কোন গ্রামে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এ সবই স্বপন মির্জার উদ্যোগে স্থাপিত।

এদিকে সাড়া দেশেই শহীদ মিনার রয়েছে। তবে পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন রাখে কয়জন। এমন ধারনা থেকে শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষায় গঠন করা হয়েছে এখানে একটি কমিটি। ‘গোপিনাথপুর শহীদ মিনার রক্ষনা বেক্ষন কমিটি’ নামে স্কুল-কলেজের ছাত্র, তাঁত শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দপ্তরী সহ ১১ সদস্য বিশিষ্ট এ সংগঠনের সভাপতি স্বপন মির্জা ও কাপড় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন সাধারন সম্পাদক। যাদের নিবেদিত দেখভালে সাড়া বছর পরিচ্ছন্ন ও সৌন্দর্য থাকে পবিত্র মিনারটি।

বর্তমানে এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই সকল ভাল কাজের সুচনা একুশে ফোরাম ও ঐ সংগঠনটির। এতেও স্বপন মির্জা পালন করেন সকল দায়িত্ব। প্রতিদিন ভোরে ছেলেকে স্কুলে দিয়েই তিনি ছুটে যান প্রিয় শহীদ মিনারে। ঝাড়ু দেয়া, ধোয়া-মোছা করে শুরু হয় তার দিনের কাজ। এজন্য পাশে থাকেন এলাকার খুদেরা। প্রতিদিন অন্তত ২ বার শহীদ মিনারটি ঝাড়ু দেয়া এবং সপ্তাহে ৩ বার পানি দিয়ে ধৌত করা হয়। ত্রুটি হলে মাঝে-মাঝে সাড়াদিন ও গভীর রাত পর্যন্ত কাটান রাতে আলোক সজ্জা ঠিক রাখতে। বকুল, টগর, হাসনাহেনা, বেলী, শিউলী, গন্ধরাজ, গাদা, গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা সহ অন্তত ২০টি গাছের ফুলের সমারহ শহীদ মিনারটি বলা চলে একটি পরিচ্ছন্ন উদ্যান।

এছাড়া এক পাশে ভাষা আন্দোলনের আহবায়ক ভাষা মতিনের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। এতে আরো মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে শহীদ মিনারটির। অনেকেই অবাক হয় সুন্দর শহীদ মিনারটি দেখে। দুর থেকে আসা দর্শনার্থীরা অকপটে স্বীকার করেন, পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে দেশ সেরা গোপিনাথপুর শহীদ মিনার।

শহীদ মিনারটি পরিদর্শনে আশা প্রবীন আইনজীবি এ্যাড. আনোয়ার হোসেন, ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়া হান্নান ও ভাষা সৈনিক আলী আজমল বুলবুলের ছেলে এ্যাড. কবীর আজমল বিপুল জানান, সাড়া দেশেই অনেক শহীদ মিনারে গিয়েছি। তবে এই শহীদ মিনারের মত সারা বছর যথাযথ পবিত্রতা কোথাও রক্ষা হয় কিনা বলতে পারবো না। স্বপন মির্জারা গোপিনাথপুর শহীদ মিনারটি প্রকৃত পক্ষে হৃদয় দিয়ে লালন করে বলেই এতো পরিচ্ছন্ন। আসলেই শহীদ মিনারটি দেখে আমরা অভিভুত। আমরা চাই সাড়া দেশের শহীদ মিনার গুলো যেন তাদের মত পরিস্কার রাখা হয়।

এদিকে পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনারের উদ্যোক্তা স্বপন মির্জা জানান, দেশের জন্য শহীদদের রক্তের ঋন কখনো শোধ হবেনা। চেষ্টা করি তাদের বিনম্র শ্রোদ্ধা জানানোর। বিশেষ করে যেখানে যাই শহীদ মিনার গুলোর কাছে দাঁড়াই। বেদীতে ময়লা, অপরিস্কার এবং পাশে যখন প্রেসাব করা দেখি তখন খুব কষ্ট পাই। পবিত্রতা রক্ষার জন্য বলেও আসি যাকে পাই। কাজের চাপে অন্যটার অতোটা সময় দিতে না পারলেও অন্তত আমি একটির দায়িত্ব নিয়েছি পবিত্রতা রক্ষার জন্য। দুর থেকে অনেকেই পরিদর্শনে এসে আমাদের শহীদ মিনার দেখে অবাক হয়, প্রশংসা করে। তখন ভাল লাগে। আমি চাই ৫২,৭১-এ যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা মায়ের ভাষা ও দেশ পেয়েছি তাদের যেন যথাযথ মর্যাদায় সম্মান দেয়া হয়। একটি সাধারন উদ্যোগ নিলেই পরিচ্ছন্ন থাকে আমাদের প্রাণের মিনার গুলো। সেদিকে সবাইকে সচেতন হবার আকুতি আমার।

এলাকার দরিদ্র তাঁত ব্যবসায়ী নুরু সরকার, হজরত আলী মোল্লা জানান, স্বপন মির্জা সব কাজ ফেলে অন্তত প্রতিদিন একবার করে এসে শহীদ মিনারটি পরিস্কার করে বলে আমাদের সন্তানরাও তার কাছ থেকে শিখে ওরাও প্রতিদিন কাজে হাত বাড়ায়। তাই আমরা গর্ব করি আমাদের পবিত্র পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার নিয়ে।

এদিকে শহীদ মিনারটির নির্মানে উদ্যোক্তা একুশে ফোরাম সিরাজগঞ্জের সভাপতি আখতারুজ্জামান তালুকদার, সাধারন সম্পাদক ফজলুল হক ডনু, শাহজাদপুর সরকারী কলেজের প্রভাষক মোরশেদুর রহমান মাসুদ জানান, একটি ভাল কাজ মানেই স্বপন মির্জা। মানবতা আর দেশের জন্য মমত্ববোধ থাকলে অর্থহীনরাও যে অবদান রাখতে পারে স্বপন মির্জা সে জন। পরিচ্ছন্ন শহীদ মিনার গড়তে তার উদ্যোগ আমাদের জেলায় বিরল।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই