শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাকদিরে বিশ্বাস ও আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্টি ঈমানের দাবি (পর্ব-২)

তাকদিরে বিশ্বাস ও আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্টি ঈমানের দাবি (পর্ব-২)

তাকদির ও ভাগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। মানুষের জীবনে যা ঘটে আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। এরূপ বিশ্বাস রাখাই হচ্ছে তাকদিরের দাবি। তাকদির নিয়ে কোনো বিতর্কে জড়ানোও মুমিনদের কাম্য নয়। এখানে আল্লাহ তায়ালার এক বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে।

কাজ নষ্ট হয়ে যাওয়াও আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় :

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদি. বলেন, অনেক সময় একজন ব্যবসায়ী চিন্তা করে, আমি অমুক পণ্যটি বিক্রি করে এত টাকা লাভ করব কিংবা কোনো বিশেষ পদ বা চাকরি লাভের আশায় এক ব্যক্তি চেষ্টা করে এবং ভাবে, চাকরিটি হলে বা অমুক পদটি পেলে বড় ভালো হবে আর চাকরিপার্থী ও ব্যবসায়ী দু’জনেই এর জন্য দৌড়ঝাপ ও কোশেশ করে, দোয়া করে, অন্যদেরকে দিয়েও দোয়া করায়। কিন্তু যখন কাজটি সম্পূর্ণ গুছিয়ে আনে এবং কাজটি হয়ে যাওয়ার নিকটবর্তী থাকে ঠিক তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে বলেন, আমার এ অবুঝ ও অজ্ঞ বান্দা পণ্যটি বিক্রির জন্য কিংবা পদ ও চাকরি লাভের জন্য এর পেছনে ছুটছে এবং এর জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি জানি, যদি তার এ পণ্যটি বিক্রি হয় কিংবা সে এ পদ পায় তা হলে সে জাহান্নামে নিক্ষেপিত হবে। তাই এ পদ বা পণ্যটি তার নাগালের বাইরে নিয়ে যাও। তাই শেষ মুহূর্তে এসে দেখা যায় পণ্যটি বিক্রয়ে কিংবা পদ বা চাকরি লাভে কোনো প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়িয়েছে। তাই পণ্যটি বিক্রি হয় না কিংবা পদ বা চাকরি বিরত হয়।

এ মুহূর্তে আমরা কি করি? আমরা কাঁদি আর অভিযোগ করি যে, অমুক ব্যক্তি এসে আমার কাজ নষ্ট করে দিল। আমরা কাজ নষ্ট হওয়ার জন্য অন্যকে দোষারোপ করি। অথচ কাজ নষ্ট করেছেন আল্লাহ। যা করেছেন তা তার মঙ্গলের জন্য করেছেন। কারণ সে যা চেয়েছিল তাহলে তাকে পরকালে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হত। এটাই হলো তাকদির এবং আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা। এর ওপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

তাকদিরে বিশ্বাসের উপর ঈমান এনেছি :

তাকদিরের ওপর বিশ্বাস ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলোর অন্যতম। যখন কোনো বান্দা ঈমান আনে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গে তাকদিরের ওপরও ঈমান আনে, কিন্তু সাধারণত মানুষের জীবনে এ বিশ্বাসের প্রভাব দেখা যায় না, এ বিশ্বাসের উপস্থিতি থাকে না এবং এর প্রতি ধ্যান থাকে না। এ কারণে দুনিয়াতে সে পেরেশান থাকে। তাই সুফিয়ায়ে কেরাম বলেন, তোমরা এ আকিদার ওপর যখন ঈমান এনেছ তখন এটিকে তোমাদের জীবনের অংশ বানাও। এর ধ্যান পয়দা কর, একে মনে রাখ এবং যখনি কোনো ঘটনা ঘটে তখনি এর স্মরণ তাজা করো যে, আমি আল্লাহর তাকদিরের ওপর ঈমান এনেছি, তাই আমাকে এর ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একজন সাধারণ মানুষের মাঝে এবং সুফিয়ায়ে কেরামের তত্বাবধানে নিজ জীবনকে যে ব্যক্তি গড়ে তুলেছে এ দুজনের মাঝে এটাই পার্থক্য। তাই যখনি কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে, সঙ্গে সঙ্গেই ইন্নালিলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন পড়ুন এবং এটি আল্লাহর ফয়সালা বলে বিষয়টিকে আল্লাহর হাওয়ালা করে দিন। দীর্ঘদিন সাধনা করার দ্বারা এবং নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে এটি মানবজীবনের একটি হাল বা অবস্থায় পরিণত হয়। কারো এরূপ হাল তৈরি হলে দুনিয়াতে তার আর কখনোই পেরেশানি হয় না। আল্লাহ তায়ালা তাকদিরের এ বিশ্বাসকে আমাদের হাল বানিয়ে দিন।

এই পেরেশানি কেন :

দেখুন, দুঃখ-কষ্ট এক জিনিস আর পেরেশানি আরেক জিনিস। দুঃখ-কষ্ট সবার জীবনে আসে। এটা খারাপ নয়। কিন্তু দুঃখ-কষ্টের কারণে যে অস্থিরতা এবং পেরেশানি বিরাজ করে এটা খারাপ। এর কারণ কি? কারণ সে সংশ্লিষ্ট ঘটনার ওপর বিবেক-বোধগতভাবে সন্তুষ্ট নয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমার সাধ্যের মধ্যে যা কিছু ছিল আমি তা করেছি, এর পরের বিষয় আমার সাধ্যের মধ্যে নয় তাই আমি কিছুই করতে পারি না, আল্লাহ তায়ালা যেভাবে ফয়সালা করেন তাই সঠিক, এরূপ ব্যক্তি কখনো পেরেশানি ও অস্থিরতায় পড়ে না। দুঃখ-কষ্ট অবশ্যই পায় কিন্তু পেরেশান ও অস্থির হয় না।

হৃদয়ের ফলকে এ বাক্য খোঁদাই করে নাও :

শায়েখ হজরত মাসীহুলাহ খান রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে, পেরেশানির সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?’ পেরেশানি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত নয়। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যখন সম্পর্ক মজবুত হয় তখন তো পেরেশানি আসার সুযোগই নেই। কারণ, যে দুঃখ কষ্ট হচ্ছে তার জন্য আল্লাহকে বল, হে আল্লাহ, একে দূর করুন। এরপর আল্লাহ তায়ালা যে ফয়সালা করেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাক। কিন্তু পেরেশানির কি আছে? যদি ‘রেযা বিল কাযা’ বা আল্লাহ তায়ালার ফয়সালার ওপর সন্তুষ্টি স্বভাবে পরিণত হয় এবং দেহমনে মিশে যায়, তা হলে পেরেশানি আসার সুযোগই নেই।

হজরত যুন-নুন মিসরি রহ. এর প্রশান্তির নেপথ্য কথা :

হজরত যুন-নুন মিসরি রহ.-কে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, হজরত, কেমন আছেন? তিনি বলেন, খুব আনন্দে আছি। এ জগতের কোনো ঘটনাই যার সন্তুষ্টির বিপরীতে ঘটে না তার আনন্দের কি সীমা-পরিসীমা আছে? যে ঘটনাই ঘটে তাই তার সন্তুষ্টি অনুসারে হয়। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞাসা করল, হজরত, দুনিয়ার সব কাজ নিজ সন্তুষ্টি মোতাবেক হওয়া, এ স্তর তো নবীদেরও অর্জিত হয়নি? আপনি কীভাবে এটা অর্জন করলেন? উত্তরে বলেন, আমি আল্লাহর সন্তুষ্টিতে আমার সন্তুষ্টিকে বিলীন করে দিয়েছি। আল্লহর সন্তুষ্টিই আমার সন্তুষ্টি। দুনিয়ার সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসারে হয়, আমার সন্তুষ্টিও তাতেই। অতএব, যখন সব কাজ আমার সন্তুষ্টি মতো হচ্ছে তখন আমার আনন্দের কথা আর কি বলব? পেরেশানি ও অস্থিরতা তো আমার কাছে পাত্তাই পায় না। পেরেশানি হয় তার, সবকাজ যার সন্তুষ্টির বিপরীত হয়।

দুঃখ-কষ্ট বাস্তবে আল্লাহ তায়ালার রহমত :

আল্লাহ তায়ালা যাকে ‘রেযা বিল কাযা’ তথা আল্লাহ তায়ালার ফয়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকার দৌলত দান করেছেন, পেরেশানি তার ধারে-কাছে ঘেষতে পারে না। হ্যাঁ, তিনি বিপদাপদে আঘাত পান, দুঃখ-কষ্ট পান কিন্তু পেরেশান হন না। কারণ সে জানে, দুঃখ-কষ্ট যা কিছু আসছে তা আমার মালিকের পক্ষ থেকে আসছে। মালিকের মহাকৌশলের আওতায় আসছে। আমার মঙ্গলও এতেই নিহিত। এটাই আমার জন্য রহমত।

হজরত থানবি রহ. বর্ণিত উদাহরণ :

হাকিমূল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ. এর একটি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার প্রতি আপনার প্রচণ্ড ভালোবাসা আছে। কিন্তু সে দূরে থাকে বিধায় দীর্ঘদিন আপনার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত হয় না। হঠাৎ একদিন সে আসে এবং খুব চুপিসারে আপনার পেছনে এসে প্রচণ্ড জোরে কাঁধে চাপড় মারে। আপনি খুব ব্যাথা পান। আপনি চিৎকার করে উঠেন এবং গা ঝাড়া দিয়ে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে পেছনে তাকান। দেখেন আপনার প্রিয় বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে এবং হাসছে। যদি আপনি সত্যিকার প্রেমিক হন তা হলে অবশ্যই বলবেন, তুমি আরো জোরে মার আপত্তি নেই। তখন এই পঙ্ক্তিটিও আপনি পাঠ করবেন,

نہ شود نصیب دشمن کہ شود ہلاک تیغت
سر دوستاں سلامت کہ تو خنجر آزمائی

আলাহ তায়ালা স্বীয় অনুগ্রহে আমাদের জীবনে দুঃখ-কষ্টকে তার রহমত মনে করার তাওফিক দান করুন। অবশ্য আমরা যেহেতু দুর্বল তাই আলাহ তায়ালার কাছে এ ধরনের কষ্টরূপী রহমত প্রার্থনা করি না। কিন্তু যখন তা এসে পড়ে তখন তা সর্বান্তকরনে কল্যাণকর মনে করা উচিত।

দুঃখ-কষ্ট চেও না, এসে পড়লে ধৈর্যধারণ কর :

আল্লাহর কাছ থেকে দুঃখ-কষ্ট চেয়ে নেয়া আমাদের কাজ নয়। যারা দুঃখ-কষ্টের অন্তর্নিহিত মর্ম বুঝেন, অনেক সময় তারা চেয়েও নেন। অনেক সুফিয়ায়ে কেরাম থেকে চেয়ে নেয়ার কথা বর্ণিত আছে। বিশেষ করে দ্বীনের রাস্তায় যে সব দুঃখ-কষ্ট আসে, সত্যিকার আল্লাহ প্রেমিক সেগুলোকে হাজারও দুঃখ-কষ্টের ওপর প্রাধান্য দেন এবং উত্তম জ্ঞান করেন। কবি চমৎকার বলেছেন,

بجرم عشق تو کشد عجب غوغا نیسیت
تو نیز بر سر بام آ کہ خوش تماشا ایست

তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে লোকেরা আমাকে প্রহার করছে, আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। একবার এসে দেখ, তামাশার দৃশ্য বুঝি এত সুন্দর হয়!

এগুলো বড়দের কথা। আমরা যেহেতু দুর্বল; শক্তি, ক্ষমতা এবং সেরূপ যোগ্যতা নেই তাই সেসব দুঃখ-কষ্ট আল্লাহর কাছে চাই না। বরং নিরাপদ জীবন চাই; হে আল্লাহ, আমাদেরকে সুস্থতা ও নিরাপত্তা দান করুন। যখন দুঃখ-কষ্ট এসে পড়ে তখন তা দূর করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি; হে আল্লাহ, এ দুঃখ-কষ্ট যদিও আপনার নেয়ামত কিন্তু আমাদের হীনতা ও দীনতার প্রতি লক্ষ্য করে এ নেয়ামতকে সুখ-শান্তির নেয়ামতে বদলে দিন। তবে পেরেশান হওয়া উচিত নয়। এর নাম ‘রেযা বিল কাযা’। তাকদিরের ঈমান তো সবারই আছে কিন্তু এ বিশ্বাসকে নিজ জীবনের হাল এ পরিণত করা উচিত। তা হলে ইনশাআল্লাহ, পেরেশানি কাছে ঘেষতে পারবে না।

আল্লাহওয়ালাদের হাল :

আপনি আল্লাহওয়ালাদেরকে হয়ত দেখে থাকবেন যে, তারা কখনো অস্থির, পেরেশান এবং ব্যাকুল হন না। তাদের জীবনে যত বড় অঘটনই ঘটুক না কেন, তারা দুঃখ পান কিন্তু অস্থিরতা, পেরেশানি এবং ব্যাকুলতা তাদের কাছে স্থান পায় না। কারণ তারা জানেন, এ ফয়সালা আল্লাহ তায়ালার। এর ওপর সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। তাই মানুষের জীবনে যখনি কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে, তাকে আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা মেনে নিয়ে তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা একান্ত আবশ্যক। দুঃখ-বেদনা এবং পেরেশানির এটিই চিকিৎসা। এরূপ করার দ্বারা তার উচ্চ পর্যায়ের ধৈর্য হাসিল হয়। আর ধৈর্য এত উঁচু ইবাদত, যা একাই বহু ইবাদতের সমতুল্য। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে,

إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ

‘আলাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদেরকে অগুনতি সাওয়াব দান করেন।’ (সূরা: যুমার, আয়াত : ১০)। চলবে...

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই