শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছেন স্বাধীনবাংলার ফুটবলাররা?

কেমন আছেন স্বাধীনবাংলার ফুটবলাররা?

একাত্তর, বাঙলাকে দমিয়ে রাখতে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভুট্টো-আইয়ুব খানদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীকারের দাবি থেকে স্বাধীনতা। ৬ দফা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে মুক্তিযুদ্ধ। ৭ ই মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠেও তাই।

সে দিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের হয়ে বিশ্বকে জানান দিতে মাঠে নেমেছিলেন একদল তরুণ ফুটবলার। বঙ্গবন্ধু তার কালজয়ী ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকবা’। বাংলার দামাল ছেলেরা ফুটবল নিয়েই মাঠে নামে মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়তে। ফুটবল নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারা। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেন দেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে।

‘মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনবাংলা ফুটবল দল’ অনন্য এক নাম। ২৫ মার্চের পরই শুরু হয় মুক্তির সংগ্রামে চূড়ান্তে লড়াই। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আবাল-বৃদ্ধা বণিতা। বাংলার গণ মানুষের সেই লড়াইয়ে যোগ দেন খেলোয়াড়রাও। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং তহবিল সংগ্রহে অসামান্য ভূমিকা রেখে ছিলেন স্বাধীনবাংলার ফুটবলাররা। অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচে অংশ নেন তারা। ১৬টি ম্যাচ খেলে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। সংগ্রহ করেছিলেন যুদ্ধের তহবিল। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম কোনো ফুটবল দল এটি।

সেই দলের নেতৃত্ব দেন মুক্তির সেনানী ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু। পরবর্তীতে তিনিই ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক। মুক্তির সংগ্রামে ও অর্জনে তিনি যেমন লাল-সবুজ-হলুদের পতাকা উড়িয়েছেন, তেমন স্বাধীনতার পর বিশ্ব ময়দানে লাল-সবুজের পতাকা ছিল তার হাতেই।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর অনেকটা নিভৃতে বাংলার সেই সব ফুটবলারদের অবদান স্মরণ করছেন জাকারিয়া পিন্টু।

ডেইলি বাংলাদেশকে জাকারিয়া পিন্টু বলেন, সব মিলিয়ে ১৬টি ম্যাচ খেলেছিলাম। যার ১২টিতে জয়, ৩টি ড্র এবং একটিতে হেরে যাই আমরা। প্রায় ৫ লাখ টাকা সংগ্রহ হয়েছিল সেসব ম্যাচ থেকে। তখনকার দিনে এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল, যা পরবর্তীতে সাহায্য করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে। চেষ্টা করেছিলাম কিছু করে অন্তত যুদ্ধের সঙ্গী হতে। হয়েছিলামও তাই। 

অনেকটা আক্ষেপের সঙ্গে পিন্টু বলে, এখন আমাদের টিমের অনেকেই ভালো নেই। যদিও সবাইকে ভাতা দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা পদক পেয়েছি। প্রশ্ন রাখেন, তবে মৃত্যুর আগে অন্তত; দলীয় ভাবে স্বাধীনতা পদকের দাবি কি রাখতে পারি না? 

জাকারিয়া পিন্টু বলেন, অনেক দেশ ঘুরেছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো এমন ক্রীড়াপ্রেমী রাষ্ট্র নায়ক দেখিনি। তিনি দেশের যে কোনো খেলায় যে ভাবে এগিয়ে যান, নিজে উৎসাহ দেন, তা ইতিহাসে বিরল। তার দৃষ্টিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল সেই স্বাকৃতি পেলে, সবার শেষ জীবনটা হয়তো বদলে যেতো। 

দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য কাজী সালাউদ্দিন বলেন, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জন্য কাজ করতে পারা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কেউ সম্মুখ সমরে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, কেউ গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। কেউ আবার ফুটবল খেলেছে যোদ্ধাদের অর্থ সহযোগিতায়।

‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বিশ্ব ইতিহাসে একমাত্র যোদ্ধা, যারা দেশমাতৃকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দলটির অনেকেই আজ বেঁচে নেই। অনেকে আছেন আমজনতা হয়ে। যারা মারা গেছেন এবং যারা ভালো অবস্থানে নেই, তাদের জন্য মন কাঁদে বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের। মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টার কথা আমৃত্যু মনে থাকবে। দেশের বাইরে থাকলেও মন কাঁদত দেশের জন্য। আমরা একে অপরকে উৎসাহিত করতাম। আমরা ছিলাম একটি পরিবারের মতো। দেখতে দেখতে ৪৯ বছর হয়েছে। অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত মুখ। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন কাজী সালাউদ্দিন।

একাত্তরে জুলাইয়ের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে দলটির অভিষেক হয়। ছোট স্টেডিয়ামটিতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় গাছ ও দেয়াল টপকে, প্রতিবেশীর ছাদ থেকে খেলা দেখে দর্শকরা।

শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়। এ সময় স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধিরা। এ ম্যাচে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। 

জাকারিয়া পিন্টু বলেন, এখনো সেই দিনটি স্মরণ করি। আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি হচ্ছে, দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। এটি বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

সবশেষ ম্যাচটি খেলেছিল পশ্চিবঙ্গ বালুরঘাট একাদশের বিপক্ষে। বাংলাদেশের গেরিলা ক্যাম্পটিও ছিল বালুরঘাটে। খেলা শুরুর আগে খেলোয়াড়রা গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে।

স্বাধীন বাংলা একাদশ দিল্লিতে তহবিল সংগ্রহের জন্য আরেকটি ম্যাচ খেলতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, এমন সময় বহুল প্রতীক্ষিত সংবাদটি আসে- বাংলাদেশ পাকিস্তানের রোষানলমুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এতে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্মাননা দেন। দেশের বাইরে খুব কম লোকই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবদান সম্পর্কে অবগত আছেন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন পৃথিবীর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ওই দল নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। দলে যারা ছিলেন, তাদের একজনের কথার সঙ্গে অন্যজনের কথার অনেক অমিল দেখা যায়। বলতে দ্বিধা নেই স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নেই।

একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশসেরা ফুটবলাররা। স্বাধীনতা অর্জনে তাদের অবদান ভুলে যাওয়া মানে, প্রিয় স্বদেশকেই খাটো করা। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ক্রীড়াঙ্গনের সূর্যসন্তানেরা চিরদিন বাংলাদেশের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবেন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ৩৬ ফুটবলার হলেন: জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আলী ইমাম, কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, শেখ আশরাফ আলি, বিমল কর, শাহাজাহান আলম, শেখ মনসুর আলী লালু, কাজী মো. সালাউদ্দিন (ছদ্দ নাম-তুর্জ হাজরা), এনায়েতুর রহমান, কে এন নওশেরুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, আব্দুল হাকিম, তসলিম উদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম, আব্দুল মমিন জোয়াদ্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আব্দুস সাত্তার, প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু, মজিবর রহমান, খোন্দকার মো. নূরুন্নবী, লুৎফর রহমান, অনিরুদ্ধা চ্যাটার্জী, সনজিত কুমার দে, মাহমুদুর রশিদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল, সিরাজ উদ্দিন, নিহার কান্তি দাস, মোজাম্মেল হক, বীরেন দাস বিরু ও আব্দুল খালেক।

 

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই