মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

মায়ের প্রতি একটি সন্তানের আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, কারো মাতৃভাষার প্রতি আকর্ষণও তেমনি স্বাভাবিক। স্বভাব ধর্ম ইসলাম মানুষের এ স্বাভাবিক আকর্ষণ সহজেই স্বীকার করে। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। উভয়টি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণের অন্যতম উৎস। কেননা, মাতৃভাষা মানুষের পবিত্র এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। এ ভাষার মধ্যে মানুষ অংকুরিত হয়। এ ভাষার মধ্যে মানুষ সর্বদা প্রবাহিত থাকে। এ ভাষায় তাদের অস্তিত্ব স্বাক্ষরিত হয়।

ভাষা বিকৃতি করা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ, আহলে কিতাবগণ বিকৃত উচ্চারণ ও মুখ বাঁকিয়ে গ্রন্থ পাঠ করে ভাষাগত জটিলতা সৃষ্টি করত এবং তাদের অনুসারীদের ধোঁকা দিত। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভাষাগত বিকৃতি পছন্দ করেননি। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন বলেন,

وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُم بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِندِ اللّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِندِ اللّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

‘আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর, তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে, অথচ তারা যা পাঠ করছে তা আদৌ কিতাব নয় এবং তারা বলে, এসব কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত অথচ এসব আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নয়। তারা বলে, এটি আল্লাহর কথা, অথচ আল্লাহর কথা নয়; আর তারা জেনে শুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৭৮)।

অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

مِّنَ الَّذِينَ هَادُواْ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ وَيَقُولُونَ سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا وَاسْمَعْ غَيْرَ مُسْمَعٍ وَرَاعِنَا لَيًّا بِأَلْسِنَتِهِمْ وَطَعْنًا فِي الدِّينِ وَلَوْ أَنَّهُمْ قَالُواْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَاسْمَعْ وَانظُرْنَا لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ وَأَقْوَمَ وَلَكِن لَّعَنَهُمُ اللّهُ بِكُفْرِهِمْ فَلاَ يُؤْمِنُونَ إِلاَّ قَلِيلاً

‘কোনো কোনো ইহুদি তার লক্ষ্য থেকে কথার মোড় ঘুরিয়ে নেয় এবং বলে, আমরা শুনেছি কিন্তু অমান্য করছি। তারা আরো বলে, শোন না শোনার মতো, মুখ বাঁকিয়ে দ্বীনের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শণের উদ্দেশ্যে বলে ‘রায়িনা’ (আমাদের রাখাল), অথচ যদি তারা বলত, আমরা শুনেছি ও মান্য করেছি (এবং যদি বলত), শোন এবং আমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখ, তবে সেই ছিল তাদের জন্য উত্তম, আর সেটাই ছিল যথার্থ ও সঠিক। কিন্তু আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন তাদের কুফরীর ধরণ। অতএব, তারা ঈমান আনছে না, কিন্তু অতি অল্প সংখ্যক ঈমান এনেছে। (সূরা: আন-নিসা, আয়াত : ৪৬)।

অতএব, উচ্চারণ বিকৃতি তথা ভাষা বিকৃতি ইসলামে নিষিদ্ধ। এ জন্য দেখা যায়, মূসা (আ.) স্বীয় ভাষায় উচ্চারণ বিকৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন,

وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي

يَفْقَهُوا قَوْلِي

‘আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সূরা: ত্বাহা, আয়াত: ২৭-২৮)।

কাজেই ভাষার বিকৃতি পরিত্যাজ্য। কারণ, ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চারণ বিকৃতি করতে করতে এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন মানুষ তার কথা শুনতে পছন্দ করে না। সুতরাং উচ্চারণ বিকৃতি বৈধ নয়; বরং ভাষার মাধূর্য বৃদ্ধির জন্য সবাইকে আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।

মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য যত নেয়ামত দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের ভাষা বা মনের ভাব প্রকাশের জন্য তাদের মাতৃভাষা। তাই  মানুষের চিন্তা চেতনা ও মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম উপার হলো মাতৃ ভাষার মাধ্যমে তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। আর এ ক্ষমতাই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে পৃথক ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,

‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ‘বয়ান’ বা ভাব প্রকাশের ক্ষমতা তথা প্রত্যেকের মাতৃভাষা।’ (সূরা: আর-রাহমান, আয়াত: ১-৪)।

এই পৃথিবীর বৈচিত্র্য আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন। পৃথিবীর মানুষ, প্রকৃতি ও অন্যান্য সব সৃষ্টির বৈচিত্র্যের ন্যায় মানুষের ভাষার বৈচিত্র্য অন্যতম নিদর্শন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ

‘তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা: রুম, আয়াত: ২২)।  তাই পৃথিবীর সব মানুষ যেমন আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি।

প্রত্যেক মানুষের কাছে তার মাতৃভূমি যেমন মর্যাদার তেমনি তার নিকট মাতৃভাষার গুরত্ব অপরিসীম। তাই আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানুষকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করার জন্য যেসব নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন,তাদের প্রত্যেককে স্ব-জাতির ভাষায় পাঠিয়েছেন। তারা তাদের মাতৃভাষায় মানুষদেরকে সত্যের পথে আহ্বান করত। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللّهُ مَن يَشَاء وَيَهْدِي مَن يَشَاء وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা: ইব্রাহিম, আয়াত: ৪)।

অনুরূপভাবে পবিত্র কোরআন নাজিল করা হয়েছে রাসূল (সা.) এর মাতৃভাষায় তথা আরবি ভাষায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

‘আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি। যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা: ইউসূফ, আয়াত: ২)।

এ ছাড়াওি আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنذِرَ بِهِ قَوْمًا لُّدًّا

‘আমি কোরআনকে আপনার ভাষায় (আরবি) সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ প্রদান এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন।’ (সূরা: মারইয়াম, আয়াত: ৯৭)।
 
এমনি ভাবে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, 

وَكَذَلِكَ أَنزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا

‘এমনিভাবে আমি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্ক বাণী ব্যক্ত করেছি। যাতে তারা আল্লাহভীরু হয়। অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক যোগায়।’ (সূরা: ত্বোহা, আয়াত: ১১৩)।

হজরত মূসা (আ.) এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি তাই সে ভাষায় তাওরাত কিতাব নাজিল করা হয়েছে। হজরত দাউদ (আ.) এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইউনানি তাই যাবুর সে ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। হজরত ঈসা (আ.) এর উম্মতের ভাষা ছিল সুরিয়ানি তাই এ ভাষায় ইঞ্জিল কিতাব নাজিল করা হয়েছে। বিশ্ব নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর উম্মতের মাতৃভাষা ছিল আরবি তাই কোরআন তার মাতৃভাষা আরবিতে নাজিল করা হয়েছে।

ইসলাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব অবৈধ মনে করে না। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়ের ভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত। তোমাদের চাইতেও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুফলিত। (ইবনুল ‘আরাবী, আল-মু’জাম, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ৩৫৫, হাদিস নম্বর-২৩৪৫)। 

কাজেই মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করা যায়। সবারই মাতৃভাষা চর্চার, একে উন্নত করার অধিকার রয়েছে এবং এ লক্ষ্যে কাজ করা কর্তব্যও বটে। মূল আরবি ভাষা এক হলেও আরবদের গোত্রভেদে উচ্চারণ ও পঠনরীতির মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে। যাকে কেন্দ্র করে একই অর্থের বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয় যাকে আরবি পরিভাষায় মুরাদিফাত বলে।

বিদেশি ভাষা শিক্ষা বা ইহুদি-খৃস্টানদের ভাষা শিক্ষা করতে প্রখ্যাত সাহাবি হজরত যাইদ ইবনে সাবিত আনসারী (রা.)-কে তার মেধা দেখে নির্দেশ দিলেন। যাইদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, আমি মাত্র ১৫/১৭ দিনের মধ্যে তাদের ভাষা শিক্ষা করি। এরপর রাসূল্লাহ (সা.) তাদের কিছু লিখতে চাইলে আমি তা লিখে দিতাম। এবং ইহুদি-খৃস্টান কিছু লিখলে আমি তা তাকে পড়ে শুনাতাম। (সহিহ বুখারী, খণ্ড:৬, হা: ২৬৩১; ইবনু হিব্বান, ১৬/৮৪, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ১৩/১৮৬-১৮৭)।

ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সব দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী তার মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা ও গুরত্ব দেবে। আর মাতৃভাষায় অন্য সব জ্ঞানের ন্যায় ইসলামী জ্ঞানেরও চর্চা করবে। এবং মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ করবে।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার তাওফিক দান করুক। আমিন।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই