শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইতিহাসের চোখে কারবালা

ইতিহাসের চোখে কারবালা

যুদ্ধ শুরু (আশুরার দিন ভোরে): ওমর বিন সা’দের সৈন্য বাহিনী অগ্রসর হলো। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বারবার তাদের যুদ্ধবিগ্রহের দিকে না যেতে আহ্বান জানালেও তারা মোটেও কর্ণপাত করলো না অথচ এই কুফাবাসীদের রক্ষার্থেই ইমাম হোসাইন (রা.) রওনা হয়েছিলেন।

অতঃপর ইমাম হোসাইন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে জনগোষ্ঠী! তোমাদের এজন্যেই ধ্বংস হোক যে, তোমরা জটিল পরিস্থিতিতে আমার সাহায্য চেয়েছো আর আমি তোমাদের সাহায্যার্থে ছুটে এসেছি কিন্তু যে তরবারি আমার সাহায্যে পরিচালনার শপথ নিয়েছিলে আজ আমাকে হত্যার জন্য সে তরবারী হাতে নিয়েছো। তোমরা যে আগুনে আমাকে জ্বালানোর জন্য প্রজ্বলিত করেছো, আমি চেয়েছিলাম এ আগুন দিয়ে আমার ও তোমাদের দুশমনদের জ্বালিয়ে দেবো। আজ তোমরা নিজের বন্ধুকে হত্যা এবং দুশমনদের সাহায্যে ছুটে এসেছো। তোমাদের জন্য আফসোস্!’

‘আল্লাহর কসম। আমার মৃত্যুর পর তোমরা বেশিদিন বাঁচবে না। তোমাদের জীবন কোনো সওয়ারীতে আরোহণ এবং নেমে পড়ার অধিক সময় স্থায়ী হবে না।’

ওমর বিন সা’দ সামনে অগ্রসর হয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)  এর সঙ্গীদের দিকে একটি তীর নিক্ষেপ করলো। ইমাম হোসাইনের নির্দেশে তার বাহিনীও পাল্টা দুটি অভিযান চালান এবং অনেকেই শাহাদাত বরণ করেন।

ইয়াজিদের সেনাপতি হোর ইবনে ইয়াজিদের আগমন ইমাম হোসাইনের পক্ষে। হঠাৎ হোর ইবনে ইয়াজিদ উবায়দুল্লার সেনাপতি ওমর বিন সা’দকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হোসাইনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও?’

ওমরের জবাব- ‘হ্যাঁ! আল্লাহর শপথ। এমন যুদ্ধ করবো যাতে সহজেই শরীর হতে মাথাগুলো বিচ্ছিন্ন করা যায় আর হাতগুলো ধড় থেকে পৃথক করা যায়।’

হোর ইবনে ইয়াজিদ ছিলেন কুফার সবচেয়ে বড় পরীক্ষিত যোদ্ধা তবে ওমরের এমন জবাবে তিনি দল থেকে পৃথক হয়ে যান এবং কাঁপতে থাকেন। মুহাজির বিন আউস জিজ্ঞেস করলেন সে কাঁপছে কেনো? জবাবে হোর বললেন, ‘আল্লাহর কসম আমি নিজেকে বেহেশত ও দোযখের মাঝখানে দেখছি। তবে খোদার শপথ, বেহেশত ব্যতীত অন্যকিছুকে প্রাধান্য দেবো না। এতে যদি নিজের শরীর টুকরো হয় বা জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়।’

তিনি হাঁক দিয়ে ইমাম হোসাইনের দিকে অগ্রসর হয় এবং বলতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি, আমার তওবা কবুল করো কারণ আমি তো তোমার বন্ধু এবং তোমার নবী নন্দিনীর সন্তানদের ভয় দেখিয়েছি।’

নিজের জীবন আল্লাহর পথে বিসর্জন দেয়ার বাসনা নিয়ে তিনি ইমাম হোসাইনের দলে চলে আসেন এবং যেহেতু তিনিই প্রথম ইমাম হোসাইনের পথ রুদ্ধ করেছিলেন তাই তিনিই প্রথম শহিদ হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন ইমামের কাছে। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে যখন তিনি শহিদ হন তার মরদেহ ইমাম হোসাইনের নিকট আনলে তিনি মুখমণ্ডল হতে ধুলাবালি সরিয়ে দিলেন।

ইমাম হোসাইনের পুত্রদ্বয়ের মৃত্যু:

একের পর এক সাথী নিহত হওয়ার পর ইমাম হোসাইনের পুত্র আলী আকবর (রা.) যুদ্ধের অনুমতি নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে এবং চরম পিপাসার্ত হয়ে পিতার নিকট ফিরে এসে পানির খাওয়ার চরম আকুতি জানায়। তবে ইমাম হোসাইন তাকে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করার নির্দেশ দিলে তিনি ফিরে যান এবং মুনকিজ বিন মুররা আবদীর ছোঁড়া তীরে শাহাদাত বরণ করেন। 

এরপর কাসেম বিন হাসান (রা.) এর মৃত্যুর পর ইমাম হোসাইন তাবুর দরজায় এসে যয়নবকে বলেন, ‘আমার ছোট ছেলেকে দাও, তার কাছ হতে বিদায় নিই।’

তবে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দুধের শিশুকে হাতে তুলে নিয়ে চুমু দেয়ার জন্য তুলবেন এমন সময় হারমালা বিন কাহেলের ছোঁড়া তীর এসে শিশুর গলায় বিদ্ধ হয়। যার ফলে শিশুপুত্র আলী আসগর শহিদ হন। শিশুপুত্রকে নিচে রেখে তার তাজা রক্তে হাত রঞ্জিত হয়ে পড়ে এবং রক্ত ছুঁড়ে দেন আকাশের দিকে, ‘এসব মুসীবত আমার জন্য খুবই সহজ। কেননা, এসবই আল্লাহর রাস্তায় হচ্ছে আর আল্লাহ দেখছেন।’ হজরত ইমাম বাকের (রা.)  বলেন, ছুঁড়ে মারা রক্তকণার একটুও জমিনে ফিরে আসেনি।

ইমাম হোসাইনের ময়দানে অবতরণ:

তিনি ময়দানে নেমে শত্রুপক্ষকে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। দুশমন পক্ষের খ্যাতনামা যোদ্ধারা একে একে ইমাম হোসাইনের আঘাতে ধরাশায়ী হচ্ছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে চলতে শত্রুপক্ষ ইমাম হোসাইনের তাঁবুর কাছে পৌঁছালে ইমাম হোসাইন ফরিয়াদ জানায়, যেন তাঁবুতে অবস্থিত নারীদের ক্ষতি করা না হয়। তিনি যতোক্ষণ জীবিত আছেন কেউ যেন তাঁবুতে না ঢুকে। শিমার তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করলো।

এরপরই শিমারের নেতৃত্বে ইমাম হোসাইনকে হত্যার পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়া হয় এবং হামলা চালায়। পাল্টা আক্রমণ ইমাম হোসাইন প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তবে তিনি প্রচণ্ড পিপাসার্ত হয়ে পড়লে শত্রুপক্ষ হতে পানি চাইলে এক ফোঁটা পানিও তাকে দেয়া হলো না। অভিশপ্ত শিমারের নেতৃত্বে থাকা দলেরা ইমাম হোসাইনের বদনে প্রায় ৭২ টি আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে।

আঘাতের কারণে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বলতার দরুণ বেশ কিছু সময় যুদ্ধ করতে সক্ষম হোন। এমনসময় একটি পাথর এসে তার পেশানিতে আঘাত করলে রক্ত গড়িয়ে তার জামা ভিজতে শুরু করে। তিনি রক্তের স্রোত বন্ধ করতে উদ্যত হলে একটি বিষাক্ত ত্রিশুল এসে ইমামের বুকে বিদ্ধ হয়। তিনি ত্রিশুলটি টেনে বের করেন এবং রক্ত বন্যার মতো গড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়েও দাঁড়িয়ে রইলেন। এতো সৈন্য থাকার পরেও কেউ মহানবীর (সা.) দৌহিত্রকে হত্যা করার সাহস জোগাতে পারলো না এবং আল্লাহর কাছে মহানবীর (সা.) দৌহিত্র হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে পিছু হটে যায়।

তবে কান্দা গোত্রের মালেক বিন ইয়াসর ইমাম হোসাইনের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে অত্যন্ত খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করে মাথায় তরবারী চালিয়ে দেন। তরবারি তার পাগড়ী ভেদ করে মাথায় ঢুকে যায়। উক্ত পাগড়ী ছিলো মহানবী (সা.) এর যা ইমাম হোসাইনের রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে। ইমাম একখানা রুমাল দিয়ে মাথা বাঁধলেন এবং একটি টুপি চাইলেন। এরপর পাগড়ী দিয়ে ভালোভাবে মাথা বাঁধেন। সামান্য বিরতি দিয়ে যিয়াদের সৈন্য তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে।

এরপর ওমরে নির্দেশে বেশ কয়েকজন ইমাম হোসাইনের মাথা হতে ধড় বিচ্ছিন্ন করতে এগিয়ে গেলেও ফিরে আসে। নাবালক ভাতিজা আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান তাঁবু হতে দৌড়ে এসে চাচার সামনে এসে দাঁড়ায় তবে শত্রুপক্ষের তীরের আঘাতে সেও শহিদ হয়।

শিমার জিল জওশন এগিয়ে আসলে ইমাম হোসাইন আসরের নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়ে নামাজ পড়াকালীন সিজদায় যখন নত হোন সেসময় শিমার তার ওয়াদা ভঙ্গ করে বলে, ‘খোদার শপথ! আমি তোমার মাথা বিচ্ছিন্ন করছি এটা জেনেও যে তুমি মহানবীর দৌহিত্র এবং পিতা-মাতার দিক হতে অতি উত্তম।’ এ বলে মহানবীর (সা.) প্রিয় দৌহিত্রের শরীর হতে মাথা ছিন্ন করে ফেলে।

ইমাম হোসাইনের মৃত্যুর পরবর্তীতে অপরাধীদের শাস্তি:

মোখতার সাকাফী পরবর্তীতে ইমাম হোসাইনের মৃত্যুতে সহায়তা করা সেনান বিন আনাসকে পাকড়াও করে এবং তার আঙ্গুলগুলোর প্রতিটি গিঁট বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইমাম হোসাইনকে উলঙ্গ করে ফেলায় অভিশাপে আবহুর বিন কা’বের দুরারোগ্য ব্যাধী হয়। যার ফলে তার হাত শুকনো কাঠ এবং ঠাণ্ডা হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে যতোদিন তার মৃত্যু হয়নি ততোদিন। তার জামা খুলে পরিধান করা ইসহাক বিন হাবিয়া হাজরামী শরীরে শ্বেতরোগের সৃষ্টি হয় এবং শরীরের সব পশম ঝরে পড়ে। ইমামের পাজামা পরিধান করা আবহোর বিন কা’বের শরীর অবশ হয়ে যায়। ইমামের পাগড়ী নিয়ে পরিধান করা জাবের বিন ইয়াজিদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। তাঁর আংটি নেয়ার অপরাধে বোজদিল বিন সালিনকে হাত পা কেটে ছেড়ে দেয়া হয় মোখতারের নির্দেশে। বর্মটি নিয়ে আসে ওমর বিন সা’দ তবে ওমর বিন সা’দের হত্যাকারীকে ইমাম হোসাইনের বর্মটি দান করে মোখতার।

ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কুফাবাসীর আহ্বানে এগিয়ে গিয়েছিলেন কোনো ধরণের যুদ্ধ প্রস্তুতি ছাড়াই। বিশ্বাসঘাতকতা এবং হিংস্রতার করাল থাবায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ ছিল কারবালার করুণ ও মর্মান্তিক ইতিহাস। যা আজো মুসলিম হৃদয়কে কাঁদিয়ে যায়।

 

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

শাহজাদপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগীদের সাথে মতবিনিময় সভা
সিরাজগঞ্জে পুরোদমে চলছে কৃষিবান্ধব সোলার প্রকল্পের কাজ
সিরাজগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন
বেলকুচিতে বিএসটিআই অনুমোদন না থাকায় টেক্সটাইল মিলকে জরিমানা
বেলকুচিতে পুষ্টি বিষয়ক সমন্বয় কমিটির দ্বি-মাসিক সভা অনুষ্ঠিত
স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-অফিসিয়াল যোগাযোগ বাড়াতে প্রস্তুত বাংলাদেশ
ভারতের কাছে পাঁচটি খাদ্যপণ্যের নিশ্চিত সরবরাহ চায় বাংলাদেশ
এপ্রিলে বাংলাদেশে আসছেন কাতারের আমির
গবেষণায় আরো জোর দিতে বললেন কৃষিমন্ত্রী
রংপুর ও ভোলার চরের মানুষদের সুখবর দিলেন পরিবেশমন্ত্রী
স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বৈঠক