অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালি জাতির জন্য অদম্য সাহস আর আত্মপ্রত্যয়ের । ১৯৭১ এর এই মাসকে ধরা হয় বাঙালির জন্য মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত ক্ষণ হিসাবে। এ মাসেই দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে স্বাধীনতাকামী জনতা। নতুন পতাকা, বজ্রকন্ঠ ঘোষণা ও কালোরাত- সব মিলিয়ে নানা ঘটনা প্রবাহে উত্তাল ছিল মার্চ মাস।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন সারাদেশের জনগণ স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে সময় ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কাপুরুষের মত রাতের অন্ধকারে বর্বরের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জনগণের উপর। “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে চলে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা।
এদিন, বঙ্গবন্ধুর সাথে সব আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর কাপুরুষোচিত হামলার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ছেড়ে যান পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। রাত ১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনী।
আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের মাধ্যমে পাক জল্লাদ বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের তান্ডব। হকচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। মানুষের কান্না ও আর্তচিত্কারে ভারি হয়ে ওঠে শহরের আকাশ। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হলো লাশের শহরে।
মধ্যযুগীয় কায়দায় পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো দেশেই চালায় নির্মমতা। পৃথিবীর জঘন্যতম এই গণহত্যার যেন কোনো সাক্ষী না থাকে সেজন্য বিদেশী সাংবাদিকদের ২৬ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে বের করে দেয়া হয়। এক রাতের মধ্যেই ঢাকা শহরকে মৃত্যুকুপ বানিয়ে ফেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে। আর এর মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক।
২৫ মার্চ রাত সোয়া ১টার দিকে এক দল পাকিস্তানি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। এ সময় বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে কবর দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় হায়েনার দল। অবশ্য গ্রেফতার হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। আর এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙ্গর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।
এরপরই শুরু হয় এদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ। দেশজুড়ে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। সবার মুখে কেবল একটিই স্লোগান ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
আলোকিত সিরাজগঞ্জ