মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলাম ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদ

ইসলাম ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদ

পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি অপরিহার্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রচলন শুরু হয়েছে। ফলে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থনীতির প্রভাব আছে। মানবজীবনের কোনো বিভাগই ধনবিজ্ঞানের বাইরে নয়।

এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন আদর্শকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে মোটামুটিভাবে তিনটি অর্থব্যবস্থা চালু আছে। যথা : ১. পুঁজিবাদী, ২. সমাজতান্ত্রিক এবং ৩. ইসলামী অর্থনীতি।

পুঁজিবাদী অর্থনীতি

‘পুঁজিবাদ’ শব্দটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদ সোমবার্টের লেখায় সর্বপ্রথম স্বীকৃতি লাভ করে। বেশি অর্থ উপার্জনের মূল উদ্দেশ্য থেকে পুঁজিবাদের জন্ম। পুঁজিবাদে অর্থ উপার্জনের মানসিকতা অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এই ব্যবস্থা একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি, মানবহির্ভূত পণ্য উৎপাদন, অপব্যয় ও বিলাসসামগ্রীর অত্যধিক ব্যবহারকে উৎসাহিত করে। অসংযম, স্বার্থপরতা, শিশুশ্রম ও নারী নির্যাতন পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। মজুদদারি, সুদি কারবার, ধোঁকাবাজি ও জালিয়াতি-প্রতারণা থেকে পুঁজিবাদের জন্ম। মানবজাতির অগ্রগতিতে পুঁজিবাদের অবদান থাকলেও সমাজকে দূষিত করার ক্ষেত্রেও তার অবদান সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী সহিংসতা, মন্দা, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতিসহ প্রবল মানবিক বিপর্যয় পুঁজিবাদের কারণেই ঘটছে। পুঁজিবাদ একদিকে সুদখোর, শোষক ও জালেম জমিদার তৈরি করছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে মজুর-কৃষকদের এক সর্বহারার দল। পুঁজিবাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা এবং অনৈতিকতার জন্ম দিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধর্মকে গুরুত্বহীন এবং নীতি-নৈতিকতাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে।

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি তিনটি। যথা—

ক.         ব্যক্তিমালিকানা : এই অর্থব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিমালিকানার অধিকার আছে। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণও ব্যক্তিগত মালিকানায় রাখতে বাধা নেই।

খ.         ব্যক্তিগত লাভ : উৎপাদনের বেলায় যে উদ্যোগ কাজ করে সেটি প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত লাভ অর্জনের জন্য চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

গ.         রাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যবসায়ী রাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত। ব্যক্তি তার ইচ্ছামতো ব্যবসায় পরিচালনা করবে এবং কেউ তার স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

পুঁজিবাদের ত্রুটি : অধ্যাপক হাম পুঁজিবাদের চারটি ত্রুটি উল্লেখ করেছেন। ১. পুঁজিবাদে সম্পদ ও আয়ের সমবণ্টন আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা নিরূপণে অসমতা সৃষ্টি করে, ২. পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও সুদি কারবারের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়, ৩. পুঁজিবাদ একচেটিয়াবাদের জন্ম দেয় এবং ৪. পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বেকার সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি।

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা

সমাজবাদী অর্থনীতি পুঁজিবাদের ঠিক বিপরীত। ব্যক্তিমালিকানার ত্রুটি সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স এক অসংযত চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময় মাধ্যমসমূহে ব্যক্তিমালিকানার বিলোপ ঘটানোর জন্য আবিষ্কার করেন এক অদ্ভুত অর্থনৈতিক তত্ত্ব—সমাজবাদ। এই মতবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার ফলে পুঁজিবাদের চেয়ে আরো মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে অসম্ভব অনিয়ন্ত্রিত। মানুষের সব অধিকারকে কেন্দ্রীভূত করার ফলে মানুষ একটি নিরেট বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ফলে সেখানে জনগণের চিন্তা, মত ও কর্মের সব স্বাধীনতা রহিত হয়ে মানুষ যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে স্বৈরতন্ত্র।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলনীতি : সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূলনীতি চারটি। যথা : সামষ্টিক মালিকানা : সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র নিজের মালিকানায় রাখার অনুমতি থাকলেও উৎপাদনের উপকরণ যেমন—জমি, কারখানা ইত্যাদি একক মালিকানায় রাখার অনুমতি নেই। মানে উৎপাদনের উপকরণ হবে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। পরিকল্পনা : সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থনীতির সব পরিকল্পনা করবে রাষ্ট্র। মানুষের আর্থিক চাহিদা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলনীতি সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আলোকে নির্ধারিত হবে। আর ব্যক্তি সেই আলোকে কাজ করবে। সামষ্টিক স্বার্থ : সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি নয়, স্বার্থ দেখতে হবে সবার। ব্যক্তিবিশেষের লাভের বিষয়টি এখানে বিবেচনা করে না, সবার লাভ বা স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করে রাষ্ট্র। লাভ বা মুনাফা অর্জন সবার জন্য। তবে সেটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তির জন্য নিবেদিত। সুষম বণ্টন : সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন থেকে অর্জিত আয় ব্যক্তিবিশেষের জন্য বিবেচনা করা হয় না। বরং সমাজের সব সদস্যের মধ্যে আয় সুষমভাবে বণ্টন করা হয়। সমাজতন্ত্র আদর্শ মনে করে, উৎপাদন থেকে যা আয় হবে তার ভাগ হবে সবার জন্য সমান।

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ত্রুটি : সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ত্রুটিগুলো হলো : সম্পদের ভুল মালিকানা ও অসম বণ্টন, প্রকৃত চাহিদা ও সঠিক মূল্য নির্ধারণে ব্যর্থতা, ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের সুযোগ না থাকায় এটি জনগণের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টিতে অকার্যকর, ভোক্তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করে বলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সত্ত্বেও সেখানে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ।

ইসলামী অর্থব্যবস্থা

পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ইসলাম মানবজাতির জন্য একটি সুন্দর বিকল্প ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে। ইসলামে মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং তার সামনে ভালো ও মন্দ দুটি পথই খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষ এই স্বাধীনতা একটি নৈতিক মানের ভেতর দিয়েই শুধু ভোগ করতে পারে। এই স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত নয় মোটেও। কেননা মানুষকে তার কর্মকাণ্ডের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানুষের কল্যাণের জন্যই দুনিয়ার সব কিছু সৃষ্টি করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মানুষ এসব সম্পদ ব্যবহার করবে এবং এর কল্যাণ গ্রহণ করবে। তবে যাবতীয় অনৈতিকতামুক্ত হয়ে আল্লাহর এ সম্পদরাজি ব্যবহার করতে হবে। ইসলাম এমন এক অর্থব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যাতে সমাজের সব মানুষ তা থেকে কল্যাণ লাভ করতে পারে এবং এর ফলে সমাজের মানুষের মধ্যে সব ধরনের ব্যবধান, বৈষম্য ও শোষণ-পীড়ন দূরীভূত হয়। ইসলামী ব্যবস্থার কারণে অর্থসম্পদ কারো হাতে জমা হয়ে থাকতে পারে না, বরং তা প্রতিনিয়ত আবর্তিত হয়ে গোটা সমাজের মানুষের প্রয়োজনে ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নির্দেশনা হচ্ছে, ‘তোমরা সম্পদ এমনভাবে বণ্টন করবে, যাতে ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যকার বিত্তবানদের মাঝেই শুধু আবর্তিত না থাকে। ’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৫৯ : ৭)

ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো, সব সম্পদ আল্লাহর। মানুষ সেটি খোদায়ি বিধান মতে ন্যায়-ইনসাফপূর্ণভাবে ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে সব নৈতিক মানদণ্ড মেনে চলবে। ধোঁকা, প্রতারণা, মজুদদারি, ওজনে কম দেওয়াসহ সুদ দেওয়া-নেওয়া থেকে বিরত থেকে মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। নিচে আলোচিত তিনটি অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত তুলনা তুলে ধরা হলো—

১. ইসলামী অর্থনীতি আল্লাহপ্রেরিত, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র মানবরচিত। ২.  ইসলামী অর্থনীতি তৌহিদভিত্তিক, পুঁজিবাদ জড়বাদী ও সমাজতন্ত্র দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। ৩. ইসলামী অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র ধর্মহীন। ৪. ইসলামী অর্থনীতিতে শরিয়ানিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাধীনতা অনুমোদিত, পুঁজিবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত, সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্ত। ৫. ইসলামে সম্পদের মালিকানা আল্লাহর, পুঁজিবাদে ব্যক্তির এবং সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে কো-অর্ডিনেটর, ইসলামী ব্যাংকিং কনভারশান প্রজেক্ট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

শিরোনাম:

স্টেশনে যাত্রীরাই কাটতে পারবেন ট্রেনের টিকিট
এপ্রিলের ১৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ডলার
পুলিশকে সাহায্য করবে ক্রাইম জিপিটি!
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর