চলনবিলাঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তি অথাৎ পুসরা আয়োজনে গোবর দিয়ে প্রলেপ দেয়া হিন্দুবাড়িগুলোতে । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় বাড়ির চারিদিকে। সে সময় বাড়ির উঠান, ঘড় দরজা ঝকঝক তকতক করছে। এককোণে তুলসী মন্দিরের সামনে চালের গুঁড়োর বাহারি নকশা।
বাড়ির ঘড় -দরজা, আসবাব পত্রে ভ্যাতা শোলার তৈরী ফুল ঝুলানো হয়। আর শোলার কারিগরদের বলা হয় মালাকার। এরা জীবিকার তাগিদে শোলা দিয়ে তৈরী করেন বিয়ের মটুক, কপালী সহ আরো কত কি। যদিও এই পেশা বিলুপ্তির পথে। কেননা ভ্যাতা শোলার অভাব, উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কম, পেশা পাল্টানো সহ নানা কারনে।
পৌষ সংক্রান্তি তথা পুসরা উপলক্ষ্যে হিন্দু বাড়িগুলোতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির কোনে ধুয়ে মুছে সিঁদুর মাখিয়ে রাখা ঢেঁকি। সেই ঢেঁকিঘরের সামনে থেকে পুরো উঠোন জুড়ে পিটুলির গোলা ( চালের গুড়া ও জলের মিশ্রণ) সঙ্গে ঘন করে গুলে আঁকা হয়েছে চোখ ধাঁধানো আল তুলসী বেদির সামনে আঁকা হয়েছে ‘নেড়া নেড়ি’ ( ভিন্ন মতে ‘বুড়োবুড়ি’)।
বাড়ির রান্নাঘর গুলোতে গেলে আরো দেখা যায়, সামনে থরে থরে সাজানো নানা রকম পুলিপিঠে, পাটিসাপটা। কত নাম— আস্কে পিঠে, গোকুল পিঠে, ভাজা পিঠে, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, চন্দ্রকান্তা, মুগসামলি, গোকুল পিঠে, চন্দ্রপুলি, সরুচুকলি, ভাজাপিঠে, ভাপাপিঠে, রসপিঠে, আরও কত কী। মাশ কালাই ডালের রসবড়ার স্বাদই আলাদা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, অগ্রাহায়ন মাসে নতুন ধান উঠলেই প্রস্তুতি শুরু হত শীতকালীন পিঠা পুলি পায়েসের আয়োজন । নতুন কি পুরাতন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নিয়ে আসার রেওয়াজ ছিল। ঢেঁকিতে নতুন চাল গুঁড়ো করা শুরু হল মানেই মকর পরব এসে গেল। এক সময় চলনবিলাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে তিনদিন ধরে উৎসব হতো। গরুকে ভোরে স্নান করানো তার শিং তেল মাখানো পিঠার প্রলেপ দেয়া, আমন ধানের স্তপাকার করে রাখা খড় ( নাড়া) পোড়ানো, উৎসব মানে আতপ চাল, দুধ, গুড় দিয়ে নানা রকম পিঠেপুলি তৈরি করে পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া আর এ সবই ছিল পৌষ পার্বণের এক একেকটা অংশ।
পাড়ার বৌ ঝিঁয়েরা জানান, উৎসবের প্রথম দিনেই মাটির সরা পোড়াতে হয়। আর পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে এছাড়াও তৈরী করা হয় হরেক রকম পিঠা পুলি। এক সময় প্রথম দিন সরার ভিতরে ধানের তুঁষ রেখে পাট কাঠির (শোলা) আগুনে কিছু ক্ষণ পুড়িয়ে সরাকে ( পিঠা ভাজার কড়াই) তৈরি’ করে নিতে হয়। নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় সরা পিঠে। প্রথমটি দেওয়া হয় গরুকে, তারপরে ঘরে ।
পুসরাতে অনেক সময় ধুতি পড়ে বা ধোয়া পোষাক পরিচ্ছদ পড়ে পাথরের বাটি হাতে নিতো যারা আলপনা দিতো তারা । সেই বাটিতে থাকত আতপ চালের গুড়ার তরল । সেই তরলে তিনি সাদা কাপড় ভিজিয়ে গাছে, তুলসি তলায়, উঠোনে, ঘরের দেওয়ালে ঝোপ ঝোপ করে দাগিয়ে দিতো বাড়ির যারা আলপনা আকাঁতে পটু।
পৌষপার্বনে আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করার রেওয়াজও ছিল । প্রতিবেশীদেরও ডাকা হতো। নয়তো তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হতো থালা বোঝাই পিঠেপুলি।
এদিকে চলনবিলের হাট বাজারে ভ্রাম্যমান মৌসুমী পিঠা বিক্রেতারা সন্ধ্যা হলেই পিঠা বিক্রি করেন। অনেকেই সেই পিঠা কিনে খেতে খেতে কয় কিন্তু মন আর ভরল কই। নাহ্, সে স্বাদ-গন্ধ… সে সব আর নেই!’’
আলোকিত সিরাজগঞ্জ