মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় হয়ে যেতে পারেন অন্ধ

অবহেলায় হয়ে যেতে পারেন অন্ধ

চোখের ভেতরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেটিনা। বিভিন্ন রকম শারীরিক ও চোখের সমস্যায় রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে একজন ব্যক্তি আজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে রেটিনার সমস্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ নিয়ে মানুষের সচেতনতা কম। অনেকে তো বিষয়টি সম্পর্কে জানে না।

এ জন্য প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব রেটিনা দিবস পালিত হয়। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ ভিট্রিও-রেটিনা সোসাইটি এ বিষয়ে সচেতন করতে দিবসটিকে বেছে নিয়েছে।

রেটিনা কী, এর ফলে চোখের কী সমস্যা হতে পারে, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগের কারণে কী ক্ষতি হতে পারে রেটিনার, এছাড়া কীভাবে রেটিনার রোগ প্রতিরোধ করা যায় এ নিয়ে আজকের আয়োজন।

লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিট্রিও-রেটিনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিক রেজা আলী। তিনি বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতি ও বাংলাদেশ ভিট্রিও-রেটিনা সোসাইটির মহাসচিব।

রেটিনা কী?

রেটিনা হলো চোখের একেবারে ভেতরের একটি পাতলা পর্দা, যার ওপর আলো পড়লে আমরা দেখতে পাই। এটি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল পর্দা। আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্কের বাইরের অংশ হলো রেটিনা। আলোক রশ্মি চোখের বিভিন্ন অংশ যেমন কর্নিয়া, লেন্স ভেদ করে রেটিনার ওপর পড়ে। এরপর এই আলোক রশ্মি থেকে রেটিনা তৈরি করে রং, বিভিন্ন বস্তুর রূপ বা প্রতিবিম্ব। পরবর্তীতে রেটিনা থেকে একটি নার্ভ হয়ে এই রূপ প্রেরিত হয় আমাদের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশে। তখন আমরা দেখতে পাই।

রেটিনার রোগসমূহ

রেটিনা যেমন সংবেদনশীল, ঠিক তেমন স্পর্শকাতর। নানা রকম শারীরিক রোগ ও চোখের সমস্যায় রেটিনা আক্রান্ত হয়। ফলে একজন ব্যক্তি একেবারেই অন্ধ হয়ে যেতে পারে। রেটিনা একটি অত্যন্ত পাতলা পর্দা, তারপরেও এটি ১০টি পরতে বা স্তরে তৈরি। বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রোগ হতে পারে।

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথী

ডায়াবেটিস আমাদের দেশে এখন মহামারি রূপে আর্বিভূত হয়েছে। এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী নেই। আমাদের শরীরে ইনসুলিন নামক এক হরমোন আছে যা রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। গ্লুকোজ হলো শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাবার, যার মাধ্যমে সব কোষ শক্তি অর্জন করে। কিন্তু কোনো কারণে ইনসুলিন স্বল্পতা হলে বা ইনসুলিন কাজ না করলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় যা কোষে প্রবেশ করতে পারে না। অতিরিক্ত গ্লুকোজ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহৃত হওয়ার চেষ্টা করে, যা শরীরের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। বরঞ্চ রক্তনালী ও স্নায়ুতন্ত্রেও স্থায়ী সমস্যা তৈরি করে। শরীরের সব অঙ্গকেই আক্রান্ত করে ডায়াবেটিস। যেমন হার্ট, কিডনি, লিভার এবং চোখ। ডায়াবেটিস একটি সারা জীবনের রোগ যা কখনো ভালো হয় না, নিয়ন্ত্রণে রাখাই এর একমাত্র চিকিৎসা।

ডায়াবেটিস চোখের সব অংশেরই ক্ষতি করে, সবচেয়ে বেশি করে রেটিনার। এর ফলে রোগী অন্ধও হয়ে যেতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় অন্ধত্বের সামগ্রিক কারণের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথীর জন্য অন্ধত্ব বরণ করে শতকরা ১২ দশমিক ৫ ভাগ।

ডায়াবেটিসে চোখের কী হয়

ডায়াবেটিস চোখের ছোট ছোট রক্তনালীর ক্ষতি করে। ফলে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তনালী থেকে চর্বি জাতীয় জিনিস অর্থাৎ কোলেস্টেরল ও লিপিড বের হয়ে আসে। একই সঙ্গে রেটিনার বিভিন্ন স্তরে জমা হয় তরল পদার্থ। সবকিছু মিলে রোগী ধীরে ধীরে কম দেখতে শুরু করে। কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে কম দেখা এক ভয়ংকর সমস্যা। তিনি পড়তে পারেন না, কম্পিউটারে দেখতে পারেন না এমনকি লিখতেও পারবেন না। একপর্যায়ে রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয় এবং রেটিনা ছিঁড়েও যেতে পারে। সার্বিক চিকিৎসা না হলে এই রোগী ধীরে ধীরে অন্ধত্ব বরণ করে।

এছাড়া ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী এই একই সমস্যায় ভুগতে পারেন। এক সমীক্ষায় দেখা যায় ১৫ বৎসর বা আরও অধিককাল ধরে যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের ভেতরে প্রায় ২ শতাংশ মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। আরও ১০ শতাংশের দৃষ্টিশক্তির গুরুতর অবনতি ঘটে।

উচ্চ রক্তচাপজনিত রেটিনার রোগ

উচ্চ রক্তচাপও একটি ভয়াবহ রোগ। যাতে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ। ডায়াবেটিস যাদের আছে তাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকা খুবই স্বাভাবিক। এই রোগে চোখের রেটিনার নানা সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে বেশি হয় রক্তনালী ছিঁড়ে যাওয়া বা রেটিনাল ভেইন অক্লুশন। এটা অনেকটা ব্রেইনের রক্তনালী ছিঁড়ে যাওয়া বা স্ট্রোকের মতো রোগ। সঠিক চিকিৎসা না হলে এখান থেকেও অন্ধত্ব হতে পারে।

বয়সজনিত ম্যাকুলার ক্ষয়

ম্যাকুলা হলো রেটিনার ৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার একটি জায়গা, যা সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। মূলত এই ম্যাকুলার মাধ্যমেই আমরা কোনো বস্তুকে স্পষ্ট দেখি, রং চিনি। বয়সের কারণে এই ম্যাকুলার কোষগুলো ক্ষয় হতে থাকে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের দেশেও মানুষ এখন দীর্ঘজীবন পাচ্ছে। তাই সত্তোরোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এই রোগে মানুষ একেবারে অন্ধ হয় না, তবে পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তিনি যেদিকে তাকান সেখানেই দেখতে পান ছায়া, পরিষ্কার দেখা যায় না। এই বয়সে মানুষ হয়ে যায় নিঃসঙ্গ। তিনি পড়তে চান, পারেন না। প্রিয়জন যেমন ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীর মুখটা পরিষ্কার দেখতে পান না। এটা খুবই কষ্টকর এক জীবন। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে এই রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।

রেটিনোপ্যাথী অব প্রিম্যাচিউরিটি বা অপরিণত শিশুর রেটিনার রোগ

এটি নতুন সমস্যা আমাদের দেশে। একটি শিশু যদি ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্মগ্রহণ করে বা তার ওজন ২০০০ গ্রামের কম হয়, তাহলে এই রোগ হতে পারে। বর্তমানে আমাদের দেশে অপরিণত শিশুদের যত্ন নেওয়ার বিশেষ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে ২৪ সপ্তাহে জন্ম নেওয়া শিশুও বেঁচে থাকছে, বড় হচ্ছে। এদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ অপরিণত।

কী হয় এই রোগে?

অপরিণত শিশুর রেটিনা স্বাভাবিকভাবেই অপরিণত থাকে। শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে সেই রেটিনা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণতা পায়। ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা দেয় নানা সমস্যা। রক্তনালীগুলো অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ছিঁড়ে যায় রেটিনা। শিশু অন্ধ হয়ে যায়। অথচ এই শিশু যদি মায়ের গর্ভে আর কিছু দিন থাকতো, তাহলে সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করতো। শতকরা এই ৩০ ভাগ শিশুকে খুঁজে বের করতে দরকার চক্ষু বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা (স্ক্রিনিং)।

এই রোগের চিকিৎসা আছে। লেজার করা হয়, চোখের ভেতর ইনজেকশনও দেওয়া হয়। সঠিক সময়ে যদি এই রোগ ধরা যায়, তাহলে শিশুর দৃষ্টি রক্ষা করা সম্ভব। এটা যেন একেবারেই সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ। দেরি হলে রেটিনা ছিঁড়ে যায়, তখন অপারেশন করেও ভালো দৃষ্টি আনা সম্ভব হয় না।

কখন স্ক্রিনিং করতে হবে

যদি ৩৫ সপ্তাহ বা তার আগে কোনো শিশুর জন্ম হয়, এবং ওজন যদি ২০০০ গ্রাম বা তার কম হয়, তাহলে সেই শিশুর ৩০ দিন বয়সে স্ক্রিনিং করতে হবে।

এছাড়া ২৮ সপ্তাহ বা তার আগে যদি কোনো শিশুর জন্ম হয়, ওজন ১২৫০ গ্রাম বা তার কম হলে সেই শিশুকে ২০ দিন বয়সে পরীক্ষা করতে হবে।

বিশ্ব রেটিনা দিবস এই প্রথমবার আমাদের দেশে পালিত হচ্ছে। যে চারটি রোগ নিয়ে আমরা এবার জনসচেতনতা তৈরির প্রয়াস পেয়েছি, আগামী বছর তা নিশ্চয় পূর্ণতা পাবে, বৃদ্ধি পাবে কলেবর। শেষ করার পূর্বে তাই শেষ অনুরোধ-

১. যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, আর তা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বছরে একবার রেটিনা পরীক্ষা করাতে হবে।

২. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে, একই সঙ্গে বছরে একবার রেটিনা পরীক্ষা করাতে হবে।

৩. বয়স ৬০ এর ওপরে হলে বছরে একবার ম্যাকুলা বিষয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।

৪. অপরিণত শিশু জন্মগ্রহণ করলে অবশ্যই সঠিক সময়ে চোখ পরীক্ষা করাতে হবে।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

শিরোনাম:

স্টেশনে যাত্রীরাই কাটতে পারবেন ট্রেনের টিকিট
এপ্রিলের ১৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ডলার
পুলিশকে সাহায্য করবে ক্রাইম জিপিটি!
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর