
শরতের আকাশে সফেদ মেঘের খেলা। বৃহস্পতিবারের ভরদুপুরেও ওই সাদা মেঘ ঠেলে কখনো কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। তবে বৃষ্টি নেই। খুলনা নগরের কালীবাড়িঘাট এলাকার পাশের পানসিঘাট মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসছে জোহরের আজানের ধ্বনি। ইজিবাইকের হর্নের শব্দ আর কুলিদের হাঁকডাকে এলাকাটি যেন আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেটি খুলনার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে পরিচিত।
আজানের পরপরই বাজারের ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষেরা জড়ো হতে থাকেন মসজিদের পাশের একটি গলিতে। তখন ওই গলির মাথায় বড় পাতিলে চলছে রান্নাবান্নার কাজ। রান্না হচ্ছে মুরগির মাংসসহ খিচুড়ি। বিভিন্ন বয়সের জনাবিশেক মানুষ সে কাজে ব্যস্ত। কেউবা শসা-পেঁয়াজ কাটাকুটি করছেন, আবার কেউ ছোট ছোট বোতলে খাওয়ার পানি ভরে রাখছেন। ওই দলের কয়েকজন গলির দুই পাশে বিছানা পেতে বসার ব্যবস্থা করছেন। এসবই করা হচ্ছে ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য। অতিথি তাঁরাই।
সময় যত গড়াতে থাকে, ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষের ভিড় তত বাড়তে থাকে। বিছানা পেতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুবিধামতো জায়গায় বসে পড়েন তাঁরা। মসজিদের নামাজ শেষ হওয়ার পর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা মানুষের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এরপর অতিথিদের সামনে দেওয়া হয় পানির বোতল। ডেগ থেকে খিচুড়ি উঠিয়ে থালায় ভরে তা একে একে পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁদের কাছে। থালার এক পাশে দেওয়া হয়েছে ছোট গোল গোল করে কেটে রাখা শসা। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো গরম অবস্থাতেই খেতে শুরু করেন তা। দফায় দফায় এভাবে খাবার পরিবেশন করা হয় সেখানে আসা সবাইকে।
গলির শুরুর দিকে ভ্যানের ওপর বসে খাচ্ছিলেন ফিরোজা বেগম। তাঁর দুই পা হাঁটুর ওপর থেকে নেই। তাঁকে ভ্যানে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনিও খাচ্ছিলেন। এক দুর্ঘটনায় জাহাঙ্গীরের এক পা ভেঙে গেছে। তিনি ভালো করে কাজ করতে পারেন না। ভাই-বোন মিলে ভিক্ষা করেন।
ফিরোজা বেগম বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর আগে তিনি ঢাকার পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। কাজ করা অবস্থায় হঠাৎ একদিন সেখানে আগুন লাগে। তিনি তিনতলার ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন। জানে বেঁচেছেন, তবে পা দুটি কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই সময় কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন তাঁর স্বামী। এরপর অসহায় অবস্থায় ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। ভাইও অসুস্থ হলে জীবিকার তাগিদে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভিক্ষা করতে। ফিরোজা বলেন, ‘সারা সপ্তাহ ধরি অপেক্ষা করি এই খাবারের জন্যি। ভিক্ষে করি আর পেটপুরি খায়া হয় না। এক বেলা পেটপুরি ভালো খাবারের জন্যি এহানে আসি।’
সত্তরোর্ধ্ব রজব আলীর বাড়ি রূপসা উপজেলার আইচগাতী গ্রামে। দুই চোখে দেখতে পান না তিনি। সেদিনই প্রথম খেতে এসেছেন। তাঁকে ভিক্ষার কাজে সহযোগিতা করেন আরেকজন। তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে শুনিছি, এহানে পতি বিহস্পতিবার খাতি দেয়। তাই আজ আইছি। খাবার খুবই ভালো।’
সেখানে কাজ করছিলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মিঠুন কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, বড় বাজারে যাঁরা ভিক্ষা করতে আসেন, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট দিন হিসেবে বৃহস্পতিবার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ওই দিন ব্যবসায়ীরা কোনো ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। সারা দিন ভিক্ষা শেষে দুপুরে যেন একটু খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিন তিন শতাধিক ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষকে খাওয়ানো হয়। যাঁরা কাজ করেন, সবাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করেন। ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষদের এক বেলা পেটপুরে খাওয়াতে পেরে তাঁরা আনন্দিত।
খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. আরাফাত হোসেন এর প্রধান উদ্যোক্তা। ওই মসজিদের পাশেই তাঁর একটি দোকান আছে। তিনি বলেন, পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে দুজন ভিক্ষুককে হোটেলে খাওয়ানোর মাধ্যমে এ কাজের শুরু হয়। দিন দিন ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় দেখা যায়, ভিক্ষুকদের খাওয়ার টাকা দেওয়ার পরও হোটেল কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হচ্ছে। তখন বাজারের কয়েক ব্যবসায়ী মিলে অসহায় এই মানুষদের জন্য এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন। সবার আর্থিক সহযোগিতায় কাজটি করে যাচ্ছেন তাঁরা।
আলোকিত সিরাজগঞ্জ