শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী ‘ক্যাকট্যাস পার্ক’ গড়ার নেশায় সার্জেন্ট তহিদুল

ব্যতিক্রমী ‘ক্যাকট্যাস পার্ক’ গড়ার নেশায় সার্জেন্ট তহিদুল

তহিদুল ইসলাম পেশায় ট্রাফিক সার্জেন্ট (৩৯)। পেশায় পুলিশ হলেও নেশা তার ক্যাকটাস সংগ্রহ করা। ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তার। নানা ধরনের দেশি-বিদেশি গাছ-গাছালি, পশু-পাখি ও সামুদ্রিক মাছের ব্যাপারে সৌখিন তিনি। তবে ছোট থেকেই তার অন্যরকম টান ছিল ক্যাকটাসের প্রতি।

টানা ২৪ বছরে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস সংগ্রহ করেছেন তিনি। তার স্বপ্ন- এক লাখ ক্যাকটাস দিয়ে গড়বেন ‘ক্যাকটাস পার্ক’।

কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার ষোলদাগ পশ্চিমপাড়া গ্রামের মো. রহমত উল্লাহের ছেলে তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সার্জেন্ট তহিদুল। অষ্টম শ্রেণি থেকেই ক্যাকটাসের প্রেমে পড়েন। প্রথমদিকে বাড়ির আশ-পাশের নার্সারি থেকে ক্যাকটাস সংগ্রহ করতেন। এছাড়াও শিক্ষা জীবনে স্কুল-কলেজের শিক্ষা সফর ও বিভিন্ন সময়ে রোভার স্কাউটের ক্যাম্পিং এ গিয়েও ক্যাকটাস সংগ্রহ করতেন তিনি। সবাই যেখানে ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকতেন, সেখানে তহিদুল আশ-পাশের নার্সারিতে গিয়ে খোঁজ করতেন নতুন প্রজাতির ক্যাকটাসের। 

শিক্ষা জীবনের কথা স্মরণ করে সার্জেন্ট তহিদুল জানান, সে সময় আমার শিক্ষক ও বন্ধুরা দারুণভাবে সহযোগিতা করতেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরির উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে তার সংগ্রহের কিছু ক্যাকটাস নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। ঢাকার শ্যামলীর ভাড়া বাসাতেই ছাদের উপর শুরু করেন ক্যাকটাসের বাগান। এরইমধ্যে ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশের সার্জেন্ট পদে যোগদান করায় তাকে যেতে হয় রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে। এতে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয় ক্যাকটাসের সঙ্গে। তবুও মন পড়ে থাকে তার যত্নে গড়া ক্যাকটাস বাগানগুলোর প্রতি। 

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে রাজশাহীতে কর্মে যোগ দেন। নগরীর রাজপাড়ার কেশবপুর এলাকায় বাসা ভাড়া নেন এবং নতুন করে ক্যাকটাসের বাগান শুরু করেন। ভাড়াবাসার ছাদ, বেলকুনি এবং নিজ কর্মস্থল রাজশাহী ট্রাফিক অফিসের পরিত্যক্ত জায়গায় ক্যাকটাস সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। তবে কিছুদিন পরেই সম্মুখীন হন বিড়ম্বনার। সংগ্রহ ও ক্রসপলিনেশনের মাধ্যমে নতুন জাত তৈরির কারণে বাড়তে থাকা ক্যাকটাসে জায়গার সংকুলান করতে ব্যর্থ হন তিনি। এছাড়াও ভাড়াবাসার ছাদে বিভিন্ন সময় মালিকের নানা আপত্তির কারণেও বিড়ম্বনায় পড়েন তিনি।

এ সময়ে পরিচয় হয় নার্সারি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। নিজের সমস্যার কথা ব্যক্ত করেন তার কাছে। তহিদুল জানান, নার্সারি মালিক ইসমাইলেরও ক্যাকটাসের প্রতি টান ছিল। তখন ইসমাইল আমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি ছাদভাড়া নিয়ে ক্যাকটাস বাগান তৈরির প্রস্তাব দেন। ওই সময় ওহাব নামের এক শুভাকাঙ্খী রাজশাহীর সাহেববাজার মুড়িপট্টিতে তার তিনতলা ভবনের পরিত্যক্ত ছাদটি ব্যবহারের জন্য দেন।

তিনি আরো জানান, পরে ওহাব ভাইয়ের ৫০০০ স্কয়ার ফিটের সেই ছাদে নতুন উদ্যোমে শুরু হয় কাজ। জীর্ণশীর্ণ ছাদটি পরিষ্কার করে ক্যাকটাসের জন্য গড়ে তোলা হয় তিনটি শেড। আলোকায়ন, পানি সরবরাহ, বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাসের মিডিয়া তৈরি ও পলিনেশনের কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্যাকটাসের সংগ্রহ। চীন, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, ইতালি, গ্রীস, ইউক্রেন, রাশিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় ৩৫টিরও বেশি দেশ থেকে ৪০০’র বেশি প্রজাতির ক্যাকটাস সংগ্রহ করি। 

এর মধ্যে রয়েছে, অ্যাজটেকিয়াম হিন্টোনি, অ্যাজটেকিয়াম রিটেরি, জিয়োহিন্টোনিয়া ম্যাক্সিকানা, এপিথেলান্থা মাইক্রোমেরিস, মাচুকানা ইয়াঙ্গানুসেনসিস, মাচুকানা পোলজি, অ্যাকান্তক্যালিসিয়াম ব্রেভিস্পিনাম, থেলোক্যাকটাস রিঙ্কোনেসিস, ইচিনোক্যাকটাস হরিজোনথালোনিয়াস, নাভাজোয়া পিবলেসিয়ানা সাব. ফিকিসেনিই, পোলিসিফোরা এসলিফরমিস ও জিমনোক্যালিসিয়াম ম্যাজানেন্স ভার-ফেরক্স বিদেশি জাতের ক্যাকটাস। এছাড়াও বাগানে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ইফোরবিয়া, সাকুলেন্ট ও কডেক্স প্লান্ট। পরে সেগুলোর ক্রশপলিনেশনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির কাজ শুরু করি। 

ক্যাকটাস রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়ে জানতে চাইলে সার্জেন্ট তহিদ বলেন, ক্যাকটাস যেহেতু পানি কম পচ্ছন্দ করে এবং গরম বেশি পছন্দ করে। সেহেতু বর্ষা ও শীত থেকে বাঁচানোর জন্য পলি দ্বারা গ্রিন হাউজ সেড তৈরি করা হয়েছে। ক্যাকটাস লাগানোর জন্য মোটা বালি ও পাতা পঁচা সারের মিশ্রণে বিশেষ ধরনের ক্যাকটাস মিডিয়া তৈরি করা হয়। ক্যাকটাসের কমন রোগ হচ্ছে ‘পচঁনরোগ’। এ থেকে বাঁচানোর জন্য বাড়তি সর্তকতা হিসেবে মাঝে মাঝে বাগানে ফাঙ্গিসাইড স্প্রে ও আগাছা মুক্তকরণসহ পোকামাকড় দূর করতে কীটনাশকের ব্যবহার করা হয়। 

সার্জেন্ট তহিদুলের স্বপ্ন সংগৃহীত ক্যাকটাস ও ক্রশ-পলিনেশনে তৈরি ক্যাকটাসের নতুন জাত দিয়ে নিজ এলাকা কুষ্টিয়ায় এক লাখ ক্যাকটাস দিয়ে গড়বেন ‘ক্যাকটাস পার্ক’। বর্তমানে রাজশাহীতে রয়েছে ২০ হাজার ক্যাকটাস ও কুষ্টিয়ায় নিজ বাড়িতে চারটি সেডে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ক্যাকটাস। ভবিষ্যতে সংগ্রহের সংখ্যাটি আরো দ্বিগুণ করার ইচ্ছে আছে। 

তার ইচ্ছে, দেশ-বিদেশ থেকে প্রকৃতিপ্রেমী বিশেষ করে ক্যাকটাসপ্রেমীরা ছুটে আসবেন তার ক্যাকটাস পার্কে। এমন ব্যতিক্রমী স্বপ্ন লালন করে শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও সার্জেন্ট তহিদুল এখনো সময় দিচ্ছেন তার ক্যাকটাস বাগানে। পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষ হলেই ছুটে আসেন নিজের ক্যাকটাসের কাছে। 

আফসোসের স্বরে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, যতটুকু সময় পাই এই ক্যাকটাসের পেছনেই দেয়। নিজের স্ত্রী-সন্তানদেরও এতো সময় দেই না। প্রথম দিকে তারা আমার ওপর রাগ করলেও এখন তারা বোঝে ক্যাকটাসের প্রতি আমার ভালোবাসার কথা। 

ক্যাকটাস পার্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কুষ্টিয়ায় দুই থেকে তিন একর জায়গার ওপর প্রায় এক হাজার প্রজাতির লক্ষাধিক ক্যাকটাস নিয়ে ‘ক্যাকটাস পার্ক’ গড়তে চাই। পার্কটি চারিদিকে গ্যালারির মতো বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে সেখানে ভিন্ন ভিন্ন সেডে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস সুসজ্জিত রাখা হবে। ভেতরে প্রতিটি রাস্তার দু’পাশে লাইটপোস্টের সঙ্গে শোভাবর্ধন করবে বিভিন্ন প্রজাতির বড় দৃষ্টিনন্দন ক্যাকটাস ও ইউফোরবিয়া। এছাড়া পার্কটিতে স্থান পাবে বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি পাখি, সামুদ্রিক মাছ ও বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা।

ট্রাফিক পুলিশের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয়ে আরএমপি পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, প্রতিটি মানুষের নিজস্ব একটি ইচ্ছে থাকে। তিনিও তার মনের সেই ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই এবং তার স্বপ্ন যেনো বাস্তবায়ন হয় সেই কামনা রইল।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ও কৃষিবিদ মোজদার হোসেন বলেন, এটি এক ধরনের চমৎকার ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যারা ছাদবাগানে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হাতে নিয়ে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এ ধরনের উদ্যোগকে কৃষিবিভাগ সবসময় সাধুবাদ জানাই। তার যদি কোনো ধরনের কৃষি সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে তবে অবশ্যই আমাদের তরফ থেকে তাকে পুরোপুরি সহযোগিতা করা হবে।

 

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই