শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুফি মিজান মানব প্রেমের ফেরিওয়ালা

সুফি মিজান মানব প্রেমের ফেরিওয়ালা

১৯৯৯ সালের শেষ দিকে পেশাগত কারণে চট্টগ্রামের আসকারদীঘি পাড়স্থ মাউন্ট হাসাপাতালে প্রায়দিনই যাওয়া হতো। একদিন সন্ধ্যায় পরপর তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে ৩টি রোগী নামানো হলো। ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীগুলো নামার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালজুড়ে এলাহি কাণ্ড, হৈচৈ।

ম্যানেজার বোরহানকে জিজ্ঞেস করলাম, রোগীগুলো ভিভিআইপি নাকি? বোরহান বললেন, ‘না। রোগীগুলো ভিভিআইপির চেয়েও বেশি। এ রোগী সুফি মিজানের শিপিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় আহত হওয়া রোগী, পিএইচপি গ্রুপের (পিএইচপি ফ্যামেলি সে সময়ে পিএইচপি গ্রুপ ছিল) শ্রমিক। মিজান স্যারের নির্দেশ তার কোম্পানির কোনো স্টাফ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হলে ফাস্ট চিকিৎসা দিতে হবে।’

সেই প্রথম সুফী মিজানের নাম শুনেছিলাম। পরদিন দেখলাম রোগীগুলোর জন্য ব্যাগভর্তি ফল আসছে কারখানা থেকে। বাসা থেকে রান্না করে খাবার পাঠানো হচ্ছে কেবিনে-কেবিনে। সেই সঙ্গে সার্বক্ষণিক তদারকি তো চলছেই।

বিস্মিত হলাম! দেশের নামকরা কত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তারা অসুস্থ হয়ে সরকারি মেডিকেলের বারান্দায় গড়াগড়ি খায়। ফলমূল তো দূরের কথা জরুরি ওষুধ কেনার টাকাও তাদের ভাগ্যে জোটে না। আর  কোথাকার শিপিং ইয়ার্ডে আহত শ্রমিকদের জন্য সুফি মিজান ভিভিআইপি চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। ঘরে রান্না করা খাবার পাঠাচ্ছেন তাদের জন্য!

সুফি মিজান নামটার প্রতি সে সময় থেকেই অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছিল আমার মধ্যে। যদিও সে সময়ে এ মানুষটিকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ  হয়নি।

পরের ঘটনা ২০০০ সালের। মাউন্ট হাসপাতালের পাশেই মাউন্ট ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। রোজার শেষ দিকের ঘটনা।  সদ্য শুরু হওয়া মাউন্ট ডায়াগনষ্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ আর্থিক অসচ্ছ্বলতার কারণে স্টাফদের ইদ-বোনাস দিতে পারছিল না। দিতে পারছিল না মাসের বেতনও। ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে কর্মরত প্রায় ৬০জন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। 

দুই দিন বাদেই ঈদ। ঘরে ছেলে-মেয়েগুলো অপেক্ষা করছে ঈদের নতুন কাপড়ের জন্য। নতুন কাপড় তো দূরের কথা ঈদের দিন সকালে সন্তানদের মুখে সেমাই-চিনি দিতে না পারার হতাশায় সবাই যখন বিধস্ত ঠিক সে সময়ে অন্য দেবতার রূপে মাউন্ট ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের হাজির হলেন সুফি মিজানের প্রতিনিধি। সঙ্গে ব্যাগ ভর্তি টাকা। ঈদ বকসিসের বাহানায় নামে সবার হাতে তুলে দিলেন ঈদ খরচের টাকা। 

শুভাগ্যক্রমে সেদিন সে ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে উপস্থিত ছিলাম আমি। ঈদ খরচ হাতে পেয়ে প্রতিটি মানুষ চোঁখ বেয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছিল জল। দেখে বুঝলাম, এ কান্না সুখের-এই জল কৃতজ্ঞতার।     

সূফি মিজান। কাদা-মাটি থেকে উঠে আসা দেশজয়ী একজন কর্মবীর। নিজ যোগ্যতা ও কর্মের গুণে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমাদৃত হয়েছেন বিশ্বজুড়ে। দৈর্ঘ-প্রস্থের মাপে নিজেকে মাপেন নি কখনো। মেপেছেন শুদ্ধতার নিক্তিতে। মানবপ্রেমের ঐশ্বরিক বন্ধন এই মানুষটিকে বেঁধেছে ‘সুফিয়ানা’ বন্ধনে। 

সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত সদালাপী, নিরহংকার সুফি মিজান মানবপ্রেমের ফেরিওয়ালা। মুঠোমুঠো ভালোবাসাকে পাহাড়সম জড়ো করে মানুষের কল্যাণে মানবতার যে প্রাচীর তিনি নির্মাণ করেছেন সে প্রাচীর ভাঙার সাধ্য হবে না কারো।

হাজার বছর ধরে সুফি মিজানের মানবতার এই ‘সুফিয়ানা’ বন্ধন আলোক রস্মি ছাড়াবে পৃথিবী জুড়ে। আর সে আলোয় আলোকিত হবে কোটি কোটি প্রাণ। কোটি কোটি তরুণ। 

মানবসেবায় সম্প্রতি জাতীয়ভাবে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০ ফেব্রুয়ারি ওসমানি মিলনায়তনে তার হাতে এ পদক তুলে দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। 

একুশে পদকে মনোনিত হওয়ায় অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে পিএইচপি ফ্যামেলি কার্যালয়ে। সঙ্গে ছিলেন সুফি মিজানের বড় ছেলে পিএইচপি ফ্যামেলি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোহসিন। 

কক্ষে ঢুকতেই চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালেন সুফি মিজান। দুইকদম এগিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো? খুবই মৃদস্বরে উত্তর দিলাম, ভালো। বসলাম সামনের চেয়ারে। মুখোমুখি। 

দীর্ঘ সময় কথা বললেন তিনি। বললেন, নিজের কথা,সন্তানদের কথা। শুনালেন মানবতার বানী। আলাপচারিতায় বললেন, বাবা, মানুষকে ভালোবাসতে শেখো, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর পাবে। 

নারায়ণগঞ্জে জালাল জুট মিলে মাত্র ১০০ টাকা মাসিক বেতনে কর্মজীবন শুরু করা মিজানুর রহমান আজকে দেশ সেরা ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা। হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার পরও যে ‘বিনয়’ লালন করে তিনি অতিসাধারণ জীবনযাপন করেন সে বিনয়ের সিকি পরিমাণও ধারণ করতে না পারার অপরাধে বড় বেশি অপরাধী মনে হলো নিজেকে। 

ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরপরই ১৯৬৫ সালে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড) চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তিনি। দুই বছর চাকরি করার পর ’৬৭ সালেই আরেকটি ব্যাংকে যোগ দেন। স্বাধীনতার পরপরই চাকরি ছেড়ে  শুরু করেন ব্যবসা।  ব্যবসার জন্য তার মূলধন ছিল মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামেলিতে। সাধারণ পরিবার থেকে ওঠে আসা এই মানুষটির অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে প্রতিটি মুহূর্ত।

আলাপচারিতায় তিনি আরো জানান, বড় হতে গেলে ‘সত্য’ কে ধারন করতে হবে। বলেন, ‘যদি সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে চাও তবে ভালো মানুষ হতে হবে। বলেন,  মানুষ যত বেশি মানুষের জন্য কাজ করে, বিধাতা তাকে তত বেশি বড় করেন।’

১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলায় রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুফি মিজানুর রহমান। পিতা মরহুম মুহাম্মদ দায়েম উদ্দিন। মায়ের নাম রাহেতুন্নেছা। 

গ্রামের পাঠশালায় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ভারত চন্দ্র স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং ১৯৬৩ সালে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ওই কলেজে বি.কম ক্লাসে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পাশ করেন।

ব্যক্তি জীবনে মো. মোহসিন, ইকবাল হোসেন, আনোয়ারুল হক, আলী হোসেন, আমির হোসেন, জহিরুল ইসলাম ও আক্তার পারভেজ হিরু ও ফাতেমা তুজ-জোহরা নামে সাত ছেলে এক মেয়ের গর্বিত পিতা সুফি মিজানুর রহমান। স্ত্রী তাহমিনা রহমান।

পিএইচপি দেশে ২৪টির বেশি খাতে বিনিয়োগ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্টিল, ফিশারিজ, স্টকস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, পাওয়ার জেনারেশন প্ল­ান্ট, কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস, শিপিং অ্যাজেন্সি, ফ্লাট গ্লাস, লেটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্টশন, টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, প্রপার্টিজ, পেট্রো রিফাইনারি, এগ্রো প্রোডাক্ট, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, কোল্ডস্টোরেজ, শিপ  ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং, ওভারসিজ, হাসপাতাল, হাসপাতাল, অ্যায়ারলাইন্স, ইলেক্ট্রিক এবং অটো মোবাইল।

আলোকিত সিরাজগঞ্জ

সর্বশেষ:

শিরোনাম:

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের মজার স্মৃতিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা
কাজিপুরে ভার্মি কম্পোস্ট সার বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু
১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়
আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়
মেয়েদের স্কুলের বেতন না দিয়ে ধোনিদের খেলা দেখলেন তিনি
‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?
তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতে
নেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ
দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর
ঈদের দিন ৩ হাসপাতাল পরিদর্শন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দন
জুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেই